"সুখ (পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের বই)"বইটির ভূমিকা: বিশ শতকের তিরিশের দশকে ঢাকায় বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন হয়। এই আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মুসলিম সাহিত্য সমাজ' নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেন। এঁদের চিন্তাভাবনা প্রকাশের মুখপত্রের নাম ছিল শিখা। মুসলিম সাহিত্য সমাজ ‘শিখাগােষ্ঠী হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন ছিল আমাদের সংস্কৃতির একটি বিবেকী ধারা। এই ধারারই অন্যতম চিন্তাশীল ব্যক্তি ছিলেন মােতাহের হােসেন চৌধুরী। | তাঁর জন্ম ১৯০৩ সনে ১ এপ্রিল নােয়াখালী জেলার কাঞ্চনপুর গ্রামে। পিতা—সৈয়দ আবদুল মজিদ; মাতা— ফাতেমা খাতুন। মােতাহের হােসেন চৌধুরীর শৈশব থেকে মৃত্যু পর্যন্ত তাঁর মাতুলালয় কুমিল্লার দারােগাবাড়িতে কাটে। কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ থেকে ১৯২৫ সনে বি.এ. পাশ করেন এবং ১৯৪২ সনে বহিরাগত ছাত্র হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে এম.এ. পাশ করেন। কিছুকাল মিলিটারি কন্ট্রাক্টরের কাজ করলেও কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে শিক্ষকতা দিয়ে তার পেশাগত জীবন শুরু হয়। পরে তিনি উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম কলেজে আসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়ােগপত্র পেয়েছিলেন, কিন্তু পারিবারিক কারণে যােগ দিতে পারেননি। কাজেই চট্টগ্রাম কলেজেই তাঁর পেশাগত জীবনের পুরােটাই অতিবাহিত হয়। এই কলেজেই তিনি আবুল ফজলকে (১৯০৩-১৯৮৩) বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন। ১৯৫৬ সনের ১৮ সেপ্টেম্বর মােতাহের হােসেন চৌধুরী মারা যান। মােতাহের হােসেন চৌধুরীর চিন্তাভাবনার কেন্দ্রে ছিল গভীর এক সংস্কৃতিবােধ। প্রেম, কল্যাণ এবং সৌন্দর্যচেতনা তার সংস্কৃতিবােধের প্রধান কথা। তার পুরাে জীবনের সাধনা এই পরিক্রমায় নিয়ন্ত্রিত, আবর্তিত এবং বিকশিত হতে দেখা যায়। কল্যাণ এবং সৌন্দর্যকে তিনি আলাদা করে দেখেননি। তাঁর দৃষ্টিতে ও-দুইই ছিল সমান, তথা এক। তাঁর চিন্তায় সৌন্দর্য হচ্ছে পরিমিতিবােধ এবং সুনীতিবােধ। তাঁর মতে যে কাজ সৌন্দর্যবােধকে পীড়িত করে, তাই নীতিবিরুদ্ধ কাজ। সেজন্য সভ্য মানুষের একমাত্র আরব্ধ কাজ হওয়া উচিত
মােতাহের হােসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) জীবদ্দশায় পরিচিত মণ্ডলে এবং সাধারণ পাঠকদের মধ্যে বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের যদি নূন্যতম আনুকূল্য পেতেন তা হলে জীবৎকালেই তাঁর দু’চারটি বই প্রকাশিত হতাে। অতীব দুঃখের বিষয় মৃত্যুকালে তার কোনাে প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল না। সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে মােতাহের হােসেন চৌধুরী একাধিক নামে পত্রপত্রিকায় লিখেছেন, যেমন- মােতাহের হােসেন বি. এ, সৈয়দ মােতাহের হােসেন চৌধুরী বি.এ, মােতাহের হােসেন চৌধুরী এম. এ, মােতাহের হােসেন। চৌধুরী প্রভৃতি। শেষ জীবনে শুধু মােতাহের হােসেন চৌধুরীই লিখতেন। চাকরি-বাকরিসংক্রান্ত ও ব্যক্তিগত কোনাে প্রয়ােজনে তিনি তাঁর পিতৃদত্ত নাম সৈয়দ মােতাহের হােসেন চৌধুরী লিখতেন। তার পৈত্রিক বাড়ি নােয়াখালী জেলার রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে। পিতা সৈয়দ আবদুল মজিদ চৌধুরী ছিলেন একজন সাব-রেজিস্ট্রার। খ্রিস্টীয়-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে এটি ছিল সম্মানজনক চাকরি । তাদের পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, ফিরােজ শাহের রাজত্বকালে শাহ সৈয়দ আহমদ তনুরী ওরফে শাহ মিরান নামে একজন সুফি সাধক ইরাক থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই উপমহাদেশে আসেন। মােতাহের হােসেনের মাতামহ মৌলবী আশরাফ উদ্দিন আহমদের বাসভবন ছিল কুমিল্লা শহরের ‘দারােগা-বাড়ি'। এই দারােগা-বাড়িতেই মােতাহের হােসেনের জন্ম। তাঁর নিজের হাতে লেখা পুরনাে কাগজপত্র দেখে প্রবন্ধ-সমগ্রের সম্পাদক সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রমাণ পেয়েছেন তাঁর জন্মতারিখ : ১ এপ্রিল ১৯০৩।