"সভ্যতা" বইটির সম্পর্কে কিছু কথা: সভ্যতার শুরুতেই মােতাহের হােসেন লিখেছেন : বেল সাহেব তার বইখানি লেখেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে। যুদ্ধ ও তার পরবর্তীকালের কলঙ্ক-কুশিতা তাকে ওই যুক্তক রচনায় নিয়ােজিত করে। সে সময়ে মিত্রশক্তির মুখে ছিল সভ্যতার দোহাই, কিন্তু সভ্যতা আসলে কী বস্তু, তা তারা ভালাে করে বুঝে উঠতে পারেননি। লেখক নিজেও যে পেরেছিলেন, তা নয়। তাই সভ্যতা প্রকৃতপক্ষে কী, তা নিজেকে ও অপরকে বােঝাবার জন্য তিনি এ পুস্তক রচনা করেন। আমার এই রচনার মূলেও আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আমাদের দেশের অতি কদর্য হিন্দু-মুসলমানের বিরােধ। এক কথায় এ কালের কলঙ্ক-কুশিতা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ সভ্যতার নামে হয়েছিল। আমাদের দেশের হিন্দুমুসলমান দ্বন্দ্বও সংস্কৃতি-সভ্যতার নামে হচ্ছে। সংস্কৃতি ও সভ্যতা সাধারণত কী বস্তু, তা ভালাে করে না জেনেই আমরা বিশেষ সংস্কৃতি ও সভ্যতার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করছি। দৃষ্টি আচ্ছন্ন হয়ে আছে বলে এতে আমাদের বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে।...অহং মিশ্রিত মােহ থেকে মুক্তি পেয়ে মানুষ সহজভাবে সংস্কৃতি ও সভ্যতার পানে তাকাতে সক্ষম হবে, এই ভরসাতেই আমি বেল সাহেবের অনুসরণে এই বইখানি লিখবার প্রেরণা অনুভব করি।
মােতাহের হােসেন চৌধুরী (১৯০৩-১৯৫৬) জীবদ্দশায় পরিচিত মণ্ডলে এবং সাধারণ পাঠকদের মধ্যে বিশেষ শ্রদ্ধাভাজন ছিলেন। সমাজ ও রাষ্ট্রের যদি নূন্যতম আনুকূল্য পেতেন তা হলে জীবৎকালেই তাঁর দু’চারটি বই প্রকাশিত হতাে। অতীব দুঃখের বিষয় মৃত্যুকালে তার কোনাে প্রকাশিত গ্রন্থ ছিল না। সাহিত্যজীবনের নানা পর্যায়ে মােতাহের হােসেন চৌধুরী একাধিক নামে পত্রপত্রিকায় লিখেছেন, যেমন- মােতাহের হােসেন বি. এ, সৈয়দ মােতাহের হােসেন চৌধুরী বি.এ, মােতাহের হােসেন চৌধুরী এম. এ, মােতাহের হােসেন। চৌধুরী প্রভৃতি। শেষ জীবনে শুধু মােতাহের হােসেন চৌধুরীই লিখতেন। চাকরি-বাকরিসংক্রান্ত ও ব্যক্তিগত কোনাে প্রয়ােজনে তিনি তাঁর পিতৃদত্ত নাম সৈয়দ মােতাহের হােসেন চৌধুরী লিখতেন। তার পৈত্রিক বাড়ি নােয়াখালী জেলার রামগঞ্জ থানার কাঞ্চনপুর গ্রামে। পিতা সৈয়দ আবদুল মজিদ চৌধুরী ছিলেন একজন সাব-রেজিস্ট্রার। খ্রিস্টীয়-ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক যুগে এটি ছিল সম্মানজনক চাকরি । তাদের পারিবারিক সূত্র থেকে জানা যায়, ফিরােজ শাহের রাজত্বকালে শাহ সৈয়দ আহমদ তনুরী ওরফে শাহ মিরান নামে একজন সুফি সাধক ইরাক থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এই উপমহাদেশে আসেন। মােতাহের হােসেনের মাতামহ মৌলবী আশরাফ উদ্দিন আহমদের বাসভবন ছিল কুমিল্লা শহরের ‘দারােগা-বাড়ি'। এই দারােগা-বাড়িতেই মােতাহের হােসেনের জন্ম। তাঁর নিজের হাতে লেখা পুরনাে কাগজপত্র দেখে প্রবন্ধ-সমগ্রের সম্পাদক সৈয়দ আবুল মকসুদ প্রমাণ পেয়েছেন তাঁর জন্মতারিখ : ১ এপ্রিল ১৯০৩।