ফ্ল্যাপে লিখা কথা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর একাধরে শিল্পী, শিল্পগুরু এবং শিল্পরসিক। তাঁর প্রতিটি সৃষ্টিই আনন্দময় সৃজনের স্বর্ণসম্ভার। অবনীন্দ্রনাথের কালজয়ী প্রতিভঅর স্পর্শেই লুপ্তপ্রায় ভারতীয় শিল্পকলা সঞ্জীবিত হয়ে উঠেছিল নতুন নতুন সম্ভাবনায়। আবার এই অদ্বিতীয় শিল্পসৃষ্টার মধ্যেই লুকিয়েছিল যে-কথাশিল্পী মানুষটি, তাঁকে আবিষ্কার করেছিলেন তাঁরই পিতৃব্য রবীন্দ্রনাথ। সেই ‘ছবি লিখিয়ে অবনঠাকুর’- এর অনন্য অবদান এই বাগীশ্বরী প্রবন্ধমালা।
শিল্পকলার রূপতত্ত্ব ও রসতত্ত্বের এমন সরল, সুন্দর ও সহজবোধ্য ব্যাখ্যা, চিত্রশিল্প ও কথাশিল্পের এমন মেলবন্ধন, সূক্ষ্ম ও দুরূহ বিষয়ের আলোচনায় এমন বর্ণোজ্জ্বল গদ্যবিন্যাস বাংলা সাহিত্যে বিরল। শিল্পের অনুশীলনে ও যথার্থ রসগ্রহণে যাঁরা ব্রতী, তাঁদের কাছে এই বই বিবেচিত হবে ‘অধীতব্য শাস্ত্রীয় গ্রন্থরূপে’। অবনীন্দ্র-শিষ্য শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর ভাষায়, ‘শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথের বাগশ্বরী বক্তৃতামালা, রূপকলার আলোচনার ক্ষেত্রে যুগান্তকারী গ্রন্থ, এবং এ যুগে আমাদের মধ্যে রসবোধের উন্মেষসাধনে অতুলনীয় এ বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। বঙ্গসাহিত্যে এটি এক অমূল্য সম্পদ।’ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ‘রাণী বাগীশ্বরী অধ্যাপক’ এবং শিল্পাদর্শের প্রকৃত ব্যাখ্যাতা রূপে অবনীন্দ্রনাথ ১৯২১-২৯ সালের মধ্যে যে-বক্তৃতাগুলি দিয়েছিলেন সেগুলিই ১৯৪১-এ ‘বাগীশ্বরী শিল্প প্রবন্ধাবলী’ নামে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটির কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ (১৯৪১) এবং রূপা প্রকাশিত প্রথম সংস্করণ (১৯৬২) ও পরবর্তী সংস্করণের প্রবন্ধগুলি একত্র করে বর্তমান ‘আনন্দ’ সংস্করণ প্রকাশিত হল। বলা যেতে পারে, এই ধ্রূপদী গ্রন্থের এইটি সবচেয়ে নিখুঁত ও সম্পূর্ণ সংস্করণ।
সূচিপত্র * শিল্পে অনধিকার * শিল্পে অধিকার * দৃষ্টি ও সৃষ্টি * শিল্প ও ভাষা * শিল্পের সচলতা ও অচলতা * সৌন্দর্যের সন্ধান * শিল্প ও দেহতত্ত্ব * অন্তর বাহির * মত ও মন্ত্র * সন্ধ্যার উৎসব * শিল্পশাস্ত্রের ক্রিয়াকাণ্ড * শিল্পীর ক্রিয়াকাণ্ড * শিল্পে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া ভাল মন্দ * রস ও রচনার ধারা * শিল্পবৃত্তি * সুন্দর * অসুন্দর * জাতি ও শিল্প * অরূপ না রূপ * রূপবিদ্যা * রূপ দেখা * স্মৃতি ও শক্তি * আর্য ও অনার্য শিল্প * আর্য-শিল্পের ক্রম * রূপ * খেলার পুতুল * রূপের মান ও পরিমাণ * ভাব * লাবণ্য * সাদৃশ্য * বর্ণিকাভঙ্গম * গ্রন্থ-পরিচয়
Abanindranath Tagore ৭ আগস্ট, ১৮৭১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি একজন খ্যাতিমান ভারতীয় চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক এবং লেখক।তিনি প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের প্রপৌত্র এবং মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তৃতীয় ভ্রাতা গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পৌত্র ও গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কনিষ্ঠ পুত্র। সে দিক থেকে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পিতৃব্য ছিলেন। পিতামহ ও পিতা ছিলেন একাডেমিক নিয়মের প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মের শিল্পী। এ সুবাদে শৈশবেই চিত্রকলার আবহে বেড়ে ওঠেন তিনি। ১৮৮১ থেকে ৮৯ পর্যন্ত সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়ন করেন। ৮৯ সালেই সুহাসিনী দেবীর সাথে পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৯০ এ গড়া রবীন্দ্রনাথের খামখেয়ালি সভার সদস্য হয়ে তিনি কবিতা পড়েছেন, নাটক করেছেন। ১৮৯৬ সালে কোলকাতা আর্ট স্কুলের সহকারী অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন। ভারতীয়দের মধ্যে তিনিই প্রথম এই মর্যাদা লাভ করেন। ১৯১১ সালে রাজা পঞ্চম জর্জ ও রানী মেরি ভারত ভ্রমণে এলে আর্ট গ্যলারি পরিদর্শনের সময় তাদেরকে ওরিয়েন্টাল আর্ট সম্পর্কে বোঝাবার দ্বায়িত্ব পান। ১৯১৩ সালে লন্ডনে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রপ্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়, এবং তিনি ইংরেজ সরকারের কাছ থেকে সি আই ই উপাধী লাভ করেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডি-লিট প্রদান করে ১৯২১ সালে। ১৯৪২ সালে শিল্পীপত্নীর মৃত্যু হয়। ১৯৪১ থেকে ৪৫ পর্যন্ত শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর আচার্য রূপে দ্বায়িত্ব পালন করেন। অবনীন্দ্রনাথের চিত্রকলার পাঠ শুরু হয় তৎকালীন আর্ট স্কুলের শিক্ষক ইতালীয় শিল্পী গিলার্ডির কাছে। তার কাছে অবন শিখেন ড্রয়িং, প্যাস্টেল ও জলরং। পরবর্তীতে ইংরেজ শিল্পী সি এল পামারের কাছে লাইফ স্টাডি, তেলরং ইত্যাদি শিক্ষা অর্জন করেন। ভারতীয় রীতিতে তার আঁকা প্রথম চিত্রাবলি ‘কৃষ্ণলীলা-সংক্রান্ত’। এই রীতি অনুসারী চিত্রশিল্পের তিনি নব জন্মদাতা। প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা আনুমানিক ছাব্বিশ। গল্প কবিতা চিঠিপত্র শিল্প আলোচনা যাত্রাপালা পুথি স্মৃতিকথা সব মিলিয়ে প্রকাশিত রচনা সংখ্যা প্রায় তিনশ সত্তরটি। পিত্রব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর অণুপ্রেরণায় লেখালেখির সূত্রপাত। কবিগুরু ‘বাল্য গ্রন্থাবলী’র কর্মসুচী শুরুর প্রাক্কালে বলেছিলেন, ছোটদের পড়বার মত বই বাংলাভাষায় বিশেষ নেই। এ অভাব আমাদের ঘোচাতে হবে। তুমি লেখ।তিনি ১৯৫১ সালে ৫ই ডিসেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।