লেখকের কথা ‘গেরুয়া মাটির পথে’ আমার গানের প্রথম বই। চার শ গান নিয়ে প্রকাশ করার কথা ছিল জুলিগীত। কিন্তু না, সময় এক রেসের ঘোড়া। দুরন্ত গতিতে নদীর ¯্রােতধারার মতো প্রবহমান সময়; সে বসে থাকার পাত্র নয়। সেই শৈশব থেকেই গান-কবিতা আমাকে পেয়ে বসেছিল, যার থেকে মুক্তি মেলেনি আজো। বহু গান বিলুপ্ত হয়ে গেছে। শেষমেষ চার শ গানের বইয়ের আশাটাও গুড়েবালি। আমার মেজো ভাই ছিলেন বাউল-চিত্তের মানুষ। গান আর আবৃত্তি তাকে বশ করে ছিল। সেই সুরের ইন্দ্রধনু জাদুমন্ত্রের মতোই আমার ভেতর শক্ত আসন পেতে নিয়েছিল। আর কেনই-বা নেবে না? গানের বই, কবিতার বই, উপন্যাস এসবের ভেতর মেজো ভাইকে ডুবে থাকতে দেখেছি। উনি কেমন গান-পাগল ছিলেন, তার দু-একটা দৃষ্টান্ত না দিলে পাঠকের বোধগম্য হবে না। সকাল দশটায় বাৎসরিক ফাইনাল পরীক্ষা। আমার মেজো ভাই আমাদের বাড়ির উঠোনে ছায়া-শীতল গাছের নিচে বাঁশের তৈরি মাচানে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লেন। যথারীতি শুরু হলো তাঁর রবীন্দ্রচর্চা। মা বললেন, ‘পরীক্ষার পূর্বমূহূর্তে কেউ এমন নিশ্চিন্ত মনে গান করে?’ আরেক বারের কথা। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। বৃত্তি পরীক্ষা। সুদকষার একটা অঙ্ক মাথা নিতে পারছে না। আমি আমার মেজো ভাইয়ের পা চেপে বসে থাকলাম, যাতে আপাতত গান বন্ধ করে আমার সমস্যার সমাধান করেন। উনি মুখে কোনো কথা না বলে হাতের ইশারায় বুঝালেনÑ এখন আমার গানের সময়। কঠিন ম্যাথ এখন কেন? ঠিক কবিতার বেলায়ও ওমর খৈয়াম থেকে শুরু করে এমন কোনো কবি নেই, যার কবিতা তিনি গলা ছেড়ে আবৃত্তি করেননি। আমার ফুফাতো ভাই নিজাম উদ্দীন। মুখে মুখে গীতি-কবিতা বানাতেন। সেসব শোনার জন্য এলাকার জনগণ বাড়ির উঠোনজুড়ে বসে পড়ত। আমার আপন মামাতো ভাই শিবলী হায়দার মাদল। তিনি বর্তমানে ডাক্তার। হার্ট স্পেশালিস্ট। সম্ভবত তখন নবম-দশম শ্রেণির ছাত্র হবেন। জ্যোৎস্না-প্লাবিত রাত। নারিকেল-তালপাতায় লুকোনো চাঁদের গতর দেখতে এক রাতের জন্য চাপিল গ্রামে ফুফুর বাড়িতে চলে আসতেন। কলমাইর চরে আমরা চার জন। গান-কবিতায় রাত শেষ। মাদল ভাই আপন গৌরবেই মান্নাদে-কে কণ্ঠে ধারণ করে আজও বহমান। এই যে সুরের একটা আবহ প্রতিনিয়ত ঘটছে আমার অবোধ অবুঝ কচিমনে। তা শক্ত আসন করে বসে গেল সুরের আরাধনায়! সুর এক চমকপ্রদ ধ্বনি। এ সবার বোধের বিষয় নয়। যে গান লিখতে আমার কোনো কাগজ-কালির প্রয়োজন হতো না, আজো তার স্বীকৃতি মেলেনি। ছড়াগান, দেশাত্মবোধক গান, প্রেম-বিরহের সুর কণ্ঠে লেপ্টে থাকলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন হয়ে ওঠেনি। দু-একটা গানে যদিও কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে মিউজিক দিয়েছেন, তা-ও কালেভদ্রে। যেমন ছড়াগানে প্রথম মিউজিক দিলেন প্রখ্যাত সুরকার অহিদুল ইসলাম। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে থাকেন। খুকুর পুতুল টুকটুকি, আয় তোরা সব দেখ দেখি। গানটি গাইল সাবিহা ফারাহ তারিন। স্কুল-প্রতিযোগিতায় প্রথম হলো সাবিহা তারিন। ঢাকায় রাজা হোসেন সুর করলেনÑ আমার বাড়ির পথের ধারে, মুক্তো-মানিক গড়িয়ে পড়ে। গাইলেন শিল্পী অন্তরা হোসেন। আরো কিছু আধুনিক গানে সুর করলেন রাজা হোসেন। আধুনিক গান করলেন রাজা হোসেনের মিউজিকে শ্রদ্ধেয় মুকিত চৌধুরী। আকাশে মেঘ জমেছে তোমার প্রেমে মন রেঙেছে। রাজা হোসেনের মিউজিকে শ্রদ্ধেয় মুকিত চৌধুরী গাইলেন আরেকটি গানÑ অভিমানী গো কথা তো বলো, মান ভেঙে মনের দুয়ার তো খোলো! সুরকার রাজা হোসেনের কাছে আমি ঋণের দায়ে আবদ্ধ। উনি আমার গানে সুরারোপ করেছেন। শিল্পীদের দিয়ে গান করিয়েছেন। তাঁর বাসায় নিমন্ত্রণ করে আমাকে সারপ্রাইজ দিলেন। একটি পয়সা দূরে থাক, উনি আফসোস করেছেন, আমি কেন এখনো আড়ালে পড়ে আছি। পয়সা তো চাননি। উল্টো বলেছেন, ‘আমার উচিত আপনাকে সম্মানিত করা।’ অবাক আমি, বলেন কি উনি! কিন্তু দুঃখের বিষয়, দীর্ঘ পনেরো বছর আমি তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারিনি। উনি বলেছিলেন, ‘কিছু গান আমাকে দিলে আমি মিডিয়াতে গীতিকাররূপে আপনাকে পরিচিত হবার ব্যাবস্থা করে দিতে পারব।’ কিন্তু ছুটি শেষে চলে গেলাম দূর মরুতে। হারিয়ে ফেলি এই বড়মাপের মানুষটিকে। গানের ব্যাপারে আরো একজনের কাছে আমি ঋণী। তিনি মিডিয়া-ব্যক্তিত্ব ফারুক আহমদ বাদল। তাঁর মাধ্যমেই রাজা হোসেন আমার গানগুলো পেয়েছিলেন। চলচ্চিত্র প্রডিওসার আমার কাজিন বাদল ভাই আমার জন্য অনেক কাজ করেছেন। তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। অদ্যাবধি ভাইজান ঢাকার চয়ন সাহিত্য ক্লাবে ‘টপট্রেন’ ‘রেলগাছ’, নাটমÐলে নিজের কবিতা না পড়ে আমার কবিতাগুলোই ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে পড়েন। আমি আমার এই ভাইটির ঋণ শোধ করতে পারব না। শোধ করতে চাইও না। কারণ, ভাইজান যতদিন আছেন, আমার জন্য অবশ্যই কাজ করবেন। আমি গান ও সুরকে বেঁধে ফেলি আপন মনে। পথের ধারে ঘুরেফিরেই তা হয়ে যায়। এ জন্য আমি কৃতজ্ঞ ঈশ্বরের প্রতি। উনি আমাকে আয়ত কিংবা পাখির উড়াল-ডানার চক্ষু দান করেননি। দিয়েছেন দৃষ্টি। সেই দৃষ্টিতে সুন্দরের সবটুকু নির্যাস আমি তুলে নিতে পারি। দুই হাজার পনেরোতে নিউইয়র্কে অবস্থানরত হারুন খান মিউজিক দিলেন গীতি-কবিতায়। গাইলেন নিউইয়র্কের শিল্পী শামীম আরা আফিয়া। বিজয়বীথির কাব্যগাথা। বিজয়দিবসের উপর লেখা। দুই হাজার সতেরোতে মিউজিক দিলেন নিউইয়র্কের প্রথিতযশা গীতিকার সুরকার নাদিম আহমদÑ ঝরাপাতা বলে কথা। গাইলেন শিল্পী খায়রুল ইসলাম সবুজ। শিল্পী তাহমীনা শহীদ গাইলেনÑ মুক্ত-স্বাধীন মন আমার! নীল আকাশে উড়ে না আর। গল্প, কবিতা, উপন্যাসের বই-ই শুধু করছি। গানের বই করার ইচ্ছা থাকলেও হয়ে ওঠে না। ওদিকে ছোটগল্প, উপন্যাসের পাÐুলিপিগুলোও নিরাশ বদনে চেয়ে থাকে। মাঝে মাঝে ‘যুদ্ধ ও নারী’ উপন্যাসের নায়িকা অনিতা মুক্তি চায়। ওদের গতরে উইয়ের চাষবাস হবে, এই ভয়ে ওরা এখন প্রায়ই কান্নাজুড়ে বসে। আমি অসহায়। ঘরভর্তি সন্তান উৎপাদন শুভ দিক নয়; তারা যেমন পুষ্টিহীনতায় ভোগে, তেমন জন্ম থেকেই কুকড়ে পড়ে থাকে। বিড়ম্বনায় আর ঐ দিকে না গিয়ে শুধু নীরবে গান লিখেই গিয়েছি। দু-একটাতে কেবল সুর করা হয়েছে। সেগুলো আর বইয়ের আকারে আসেনি। তাই এবারের ইচ্ছা ছিল চার শ গানের সমন্বয়ে বই প্রকাশ করার। সময়ের অভাবে সেটিও হলো না। এখন করছি ‘গেরুয়া মাটির পথে’। কিছু গান, পুঁথি, গীতিনাট্য, গীতিকাব্য, নৃত্যনাট্য ও একটি স্মৃতিকথাও আছে এতে। গানগুলোতে আমি সুর করেছি কিংবা যা সুরারোপিত হয়েছে। সংগীতের মূলে যা রয়েছে তা হলো তাল, ছন্দ, রাগিনী। এই তিনটিরই আবেদন ইন্দ্রিয়জ। সংগীত বেঁচে থাকে শ্রæতির জগতে। শ্রবণেন্দ্রিয়ের পথেই সংগীতের আবেদন সত্য হয়। সংগীতের সম্মোহনী শক্তিটুকু ছন্দমাত্রিক। তাই গান লেখার কাজটি খুব বেশি সহজসাধ্য কাজ নয়। একটা সূ² নিয়মের ভেতর বন্দি থেকেই একজন গীতিকারকে অগ্রসর হতে হয়। আর সুর? সে তো ঈশ্বরের সাথে খেলা! আমি মনে করি, ঈশ্বর যাকে দান করেন, তিনিই তা পেয়ে থাকেন। আমি কৃতজ্ঞ উপরওয়ালার কাছে। রহস্যলোকের এই নন্দিত দিকটি তিনি আমাকে দান করেছেন। কর্মের সোপানেই জীবনের চারপাশ রঙিন হয়ে ওঠে। আমি নিষ্কর্ম, তাই যশহীন। তাই আমার নিরাশ হওয়ার কিছুই নেই। কচ্ছপী পায়েই হাঁটছি। গন্তব্যে পৌঁছুতে যে দমের প্রয়োজন, তা যেন নিঃশেষ না হয়। আজ আমি কিছু গান নিয়ে দর্শক-পাঠকের দ্বারে দাঁড়ালাম। জানি না, তাদের হৃদয়ে আমার ছায়া পড়বে কি না।
জুলি রহমান মূলত কবি। ছেলেবেলার গান কবিতা মুড়ি-মুড়কির মতো উড়িয়ে দিতে দিতে কখন তা চলে এলো কলমের নিপুণ ডগায় তা হলফ করে বলাই মুশকিল। বস্তুত তারই দীঘল মাঠে আজো রয়েছেন তিনি কানায় কানায় পূর্ণ; সৃষ্ট কাব্যবাণী মাত্রার অভোগী প্রত্যয়ী হয়ে। তবে তিনি শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই ছিলেন মেধাবী। স্কুল কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ম্যাগাজিন, দেয়ালিকায় তার ভূমিকা মেজাজি, মেধাবী। শিক্ষা জীবন: ঢাকা পলিটেকনিক স্কুল, লালমাটিয়া কলেজ, তিতুমীর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ করেন। স্বামী তখন প্রবাসী। তবে তার কচ্ছপী চলা বিরামহীন। শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে একসময় স্বামী সংসারের মোহে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। কবি জুলি রহমান ধামরাই থানার চাপিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম তজিম উদ্দিন মাতা ফাতেমা খাতুনের পঞ্চম সন্তান। পেশায় শিক্ষিকা জুলি রহমান একই সময় শিক্ষকতা ও শিল্প সাহিত্যচর্চার নিষ্ঠাত্রিপর্ণ প্রভায় তিনি হয়ে ওঠেন কাব্যকথা শিল্পবোধের সরসী মুকুর। সাহিত্যের নানা শাখা প্রশাখার চর্চাবর্তে তিনি নিজেকে করে চলেছেন পরিব্যাপ্ত। যার ফলশ্রæতিতে তার সৃষ্টি সৌকর্যে রূপায়িত হয়ে চলেছে সময়ের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধসহ গান গীতিকাব্য গীতিনাট্য ও পুঁথি! বাবার পুঁথিকে ধরে রাখার জন্যই তার প্রয়াস। বিবাহ পূর্বে তিনি দীর্ঘকাল ঢাকায় বিভিন্ন সাহিত্য সভাসহ পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। স্বামীর সঙ্গে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে একটানা দশ বছর সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অদম্য কাজ করেন। ধারাবাহিক উপন্যাস ‘যুদ্ধ ও নারী’, ‘বহে রক্তধারা’, ‘ব্যবধান’, ‘ফাতেমার জীবন’, ‘একজন দলিলুর রহমান’ ইত্যাদি সত্যের আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় গল্প-কবিতা রিয়াদ ডেইলিতে। রাইটার্সসহ জাগরণ রূপসি চাঁদপুর, ইত্যাদি লিটলম্যাগেও। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সম্পাদনা করেন মধ্যপ্রাচ্যে ‘জলপ্রপাত’, ‘অনিবাস’, ‘রৌদ্দুরের’। কবির প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সেই বিচারে প্রচুর নয়। মাত্র ২৫টি। তার উপন্যাস ও গল্প সমগ্র মুক্তির আকুতিতে অপেক্ষার ঘোলাজলে তর্পায়। কবিতা সমগ্র প্রস্তুতি পর্ব চলছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯শে প্রকাশ হচ্ছে ‘আয়নার যুদ্ধ’। এটি গীতিকাব্য। এ গ্রন্থের গীতিকাব্যগুলো সময়োপযোগী। স্বাধীনতার, বিজয়ের, বাংলা ভাষার, বৈশাখের, আমেরিকান কালচার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের থ্যাংক্সগিভিং, সিক্সফ্লাগ্স, বাংলার শ্বাশ্বত চিরায়ত প্রেমের গীতিকাব্য নিয়ে ‘আয়নার যুদ্ধ’ বই। এই বইটির নামকরণে যিনি তিনি লেখকের বন্ধু আলেয়া চৌধুরী। জুলি রহমানের আরও প্রচুর গীতিকাব্য ও গান আছে, যা সংখ্যাতিত। যা এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। বর্তমানে তিনি সাজুফতা সাহিত্যক্লাবের পরিচালক এবং সাজুফতা নামে সাহিত্য-কাগজও সম্পাদনা করেন।