বাঙালির সংস্কৃতি, সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনাে ও বৈচিত্র্যময়। বাংলা ভাষায় রয়েছে দুটো বর্ণমালা : প্রমিত বাংলা ও অন্যটি সিলেটি নাগরী। এটি পৃথিবীর ইতিহাসে প্রায় বিরল উদাহরণ। বাংলা ভাষা ছাড়া একই ভাষায় একাধিক বর্ণমালার ঐতিহ্য রয়েছে শুধু স্কটল্যান্ডের উত্তরাঞ্চলে। সিলেটি নাগরী লিপির উদ্ভব আরবি, কাইথি, বাংলা ও দেবনাগরীর অনুসরণে চতুর্দশ শতকে। এ-লিপিতে রচিত হয়েছে শত শত গ্রন্থ, দলিল-দস্তাবেজ এবং পরিচালিত হয়েছে সেকালের দৈনন্দিন প্রয়ােজনীয় কার্যক্রম। নাগরী লিপির সাহিত্য ধারণ করেছে সিলেটি উপভাষা বা আঞ্চলিক ভাষা। নাগরীসাহিত্যে মূলত ইসলামি নানা কাহিনি বিধৃত হয়েছে; মানবিক প্রেম-প্রণয় উপাখ্যানও প্রাধান্য পেয়েছে। এছাড়াও নবিচরিত, ধর্মের বাণী, রূপকথা, সামাজিক রচনা, সুফিবাদ, ফকিরি গান, বীরগাথা এবং মরমি কাহিনিমূলক পুথি রচিত হয়েছে। প্রায় ছয়শাে বছর বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চল বিশেষত সিলেট অঞ্চলে প্রচলিত ছিল এ-লিপির সাহিত্য। তবে, সিলেট ছাড়াও কিশােরগঞ্জ, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, ভৈরব, করিমগঞ্জ, শিলচর ও আসামে এর ব্যবহার ছিল। নাগরী পুথি-পুস্তক বর্তমানে দুস্প্রাপ্য। প্রায় ৫০ বছর পূর্বে এসব অমূল্য গ্রন্থ কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। এটি এখন বিস্মৃত ঐতিহ্যের নাম। বাংলা ভাষার এ-গৌরবগাথা এখন বিলুপ্তপ্রায়। এই হিরন্ময় অধ্যায় পুনরুদ্ধারের লক্ষ্যে প্রকাশিত হলাে বিলুপ্ত নাগরী লিপির ২৫টি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের নাগরী গ্রন্থসম্ভার। এই সিরিজে নাগরী লিপি ও সাহিত্য সম্পর্কে বিস্তারিত ভূমিকা উপস্থাপন করা হয়েছে। মূল পাঠে নাগরী লিপির পাশাপাশি বাংলা লিপ্যন্তর সংযােজন করা হয়েছে। এছাড়া গ্রন্থের পরিশেষে যুক্ত হয়েছে আঞ্চলিক শব্দাবলির অর্থ এবং পাশাপাশি নাগরী লিপি ও বাংলা বর্ণমালার বর্ণচিত্র। নাগরী লিপির গ্রন্থসম্ভার বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বর্ণাঢ্য স্মারক। নাগরী লিপি ও সাহিত্য সম্পর্কে জানার জন্য নাগরী পুথি পাঠ অবশ্যই জরুরি। এ প্রকাশনার মাধ্যমে পাঠক সে সুযােগ পাবেন।
মোস্তফা সেলিম লুপ্ত বর্ণমালা সিলেটি নাগরীলিপি ও সাহিত্য গবেষণা, প্রকাশনা এবং তার নবজাগরণে অনন্য ভূমিকা রেখে দেশে-বিদেশে নন্দিত। তাঁর কাজের মূল্যায়ন করে ‘মোস্তফা সেলিমের নাগরিপ্রেম’ শিরোনামে দৈনিক প্রথম আলো শনিবারের বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করে ১২ ডিসেম্বর ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে এবং The Daily Star প্রকাশ করে "Keeping an almost extinct script alive, a publisher's story" প্রতিবেদন। দেশে-বিদেশে এ বিষয়ে আমন্ত্রিত বক্তা হিসেবে তিনি অংশগ্রহণ করেছেন। তাঁর প্রথম গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধে বড়লেখা প্রকাশিত হয় ১৯৯৯ খ্রিস্টাব্দে। তিনি বাংলাপিডিয়া, লিবারেশনওয়ার পিডিয়াসহ বিভিন্ন গবেষণা প্রকল্পে কাজ করেছেন। নাগরীলিপির ২৫টি পুথি সম্পাদনা তাঁর উল্লেখযোগ্য কাজ। সম্পাদনা করেন মাসিক ভ্রমণচিত্র। মোস্তফা সেলিমের জন্ম মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখায়। তিনি রাষ্ট্রবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর।