‘শেষ বিকেলের মেয়ে' বইয়ের কিছু কথাঃ আকাশের রঙ বুঝি বারবার বদলায়। কখনো নীল। কখনো হলুদ। কখনো আবার টকটকে লাল। মাঝে মাঝে যখন সাদাকালো মেঘগুলো ইতিউতি ছড়িয়ে থাকে আর সোনালি সূর্যের আভা ঈষৎ বাঁকা হয়ে সহস্র মেঘের গায়ে লুটিয়ে পড়ে, তখন মনে হয়, এর রঙ একটি নয়, অনেক। এখন আকাশে কোনো রঙ নেই। আছে বৃষ্টি। একটানা বর্ষণ। সেই সকাল থেকে শুরু হয়েছে তবু থামবার কোনো লক্ষণ নেই। রাস্তায় একহাঁটু পানি জমে গেছে। অতি সাবধানে হাঁটতে গিয়েও ডুবন্ত পাথরনুড়ির সঙ্গে বারকয়েক ধাক্কা খেয়েছে কাসেদ। আরেকটু হলে একটা সরু নর্দমায় পিছলে পড়তো সে। গায়ের কাপড়টা ভিজে চুপসে গেছে। মাথার চুলগুলো বেয়ে ফোঁটাফোঁটা পানি ঝরছে। শীতে কাঁপতে কাঁপতে যখন বাসায় এসে পৌছলো কাসেদ তখন জোরে বাতাস বইতে শুরু করেছে। বোধ হয় ঝড় উঠবে আজ। প্রচণ্ড ঝড়। ভেজানো দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকতে কাসেদ দেখলো, ছোট্ট একখানা সিঁড়ির ওপরে বসে চুলোয় আঁচ দিচ্ছে নাহার, মা তসবিহ্ হাতে পাশে দাঁড়িয়ে কী নিয়ে যেন আলাপ করছেন ওর সঙ্গে। ভেতরে আসতে অনুযোগভরা কণ্ঠে মা বললেন, দ্যাখো, ভিজে কী অবস্থা হয়েছে দ্যাখো।কী দরকার ছিলো এই বৃষ্টিতে বেরুবার ? কাসেদ কোনো উত্তর দেবার আগেই মা আবার বললেন, ঠাণ্ডা লেগে তুমি একদিন মারা যাবে। এই বলে দিলাম দেখো, তুমি একদিন বৃষ্টিতে ভিজেই মারা যাবে। কেন মিছেমিছি চিন্তা করছো মা। ভেজাটা আমার গা-সওয়া হয়ে গেছে। দেখো কিচ্ছু হবে না। না হবে না। যেদিন অসুখ করবে সেদিন টের পাবে। সহসা কী মনে পড়তে খানিকক্ষণ চুপ থেকে মা শুধোলেন, ছাতাটা করেছো কি শুনি? তাইতো মা, ছাতাটা। কাসেদ ইতস্তত গলায় জবাব দিলো, ওটা সেদিন অফিস থেকে এক ভদ্রলোক নিয়ে গেছেন। তার কাছ থেকে আর আনা হয়নি। যা ভেবেছিলাম, নাহারের দিকে একনজর তাকিয়ে নিয়ে মা বিরক্তির সঙ্গে বললেন, তোর দিন যাবে কেমন করে আমায় বলতো? আজ এটা, কাল সেটা তুই শুধু মানুষকে বিলোতে থাকবি। রাজত্বি থাকতো নাহয় বুঝতাম। টানাটানির সংসার। নিজের ঘরে এসে ভেজা কাপড়গুলো দড়ির ওপর ঝুলিয়ে রাখলো কাসেদ। আলনা থেকে একটা গেঞ্জি টেনে নিয়ে পরলো। তারপর উনুনের পাশে এসে বসে বললো, বিলোচ্ছি কে বললো মা, ছাতাটা ভদ্রলোক কিছুক্ষণের জন্য চাইলেন তাই দিলাম। ওটা তো চিরকালের জন্যে দিইনি, কালই আবার.......
ক্রীতদাসের হাসি'বইয়ের ভূমিকাঃ সাধারণত লেখকের আনন্দ হয় কোন পুস্তকের নতুন পুনর্মুদ্রণের সময়। কারণ, পাঠকের নিকট যে তার চাহিদা ফুরিয়ে যায়নি, পরিস্থিতি তা জানান দেয়। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার এই উপক্রমাণিকার পেছনে আনন্দ থাকলেও তা বিষাদ-সিক্ত। ৩৪ বছর পূর্বে যখন এই উপন্যাস ছাপা হয়, তখন উৎসর্গ পৃ্ষ্ঠায় উল্লেখিত দুই জনেই ছিলেন তরতাজা যুবক আত্মার আত্মীয়। এখন একজন চিরতরে গরহাজির পৃথিবী থেকে। তিনি কবি সানাউল হক। দুবছর পূর্বে প্রায়ত। অপর জন একেরেম আহসান গুরুতর অসুস্থ। আরো স্বরণ করতে হয় আব্দুল বারী ওয়ার্সী-কে তিন দশক পূর্বে আইয়ুব খানের মিলিটারি স্বৈরতন্ত্রের যুগে যিনি এই পুস্তক প্রকাশে নৈতিক সাহস পুরস্কার পায় “ক্রীতদাসের হাসি।” বর্তমানে জনাব আব্দুল বারী ওয়ার্সীও গুরুতর অসুস্থ। পঁচাত্তরের মুখোমুখি বয়স। তিনিই প্রথম প্রকাশক। পরবর্তী কালে এগিয়ে আসেন শ্রীচিত্তরঞ্জন সাহা। প্রকাশনার ক্ষেত্রে তিনি এক উজ্জ্বল গ্রহ এবং প্রাতঃস্বরণীয় জন। আমার ধন্যবাদ তাঁর উচ্চতায় পৌঁছাবে না। তাই চুপ করে গেলাম। ‘পুথিঘর লিমিটেড’ নিরঙ্কুশ অড়্রযাত্রী হোক দেশের গুমরাহী এবং ধর্মন্ধতা ধ্বংসে-এই গুভ কামনা রইল। শওকত ওসমান
“চিলেকোঠার সেপাই” বইটি সর্ম্পকে কিছু তথ্যঃ ১৯৬৯ সালের পূর্ব বাংলা। কী এক জীবনস্পর্ধী মন্ত্রের মুখে বিস্ফোরিত চারদিক। কেঁপে ওঠে নগর ঢাকা। কাঁপে শহর, বন্দর, গঞ্জ, নিভৃত গ্রাম, এমনকি যমুনার দুর্গম চর এলাকা। কখনো কঠিন বুলেটের আঘাতে, কখনো ঘুম-ভেঙ্গে-দেওয়া আঁধির ঝাপটায়। মিটিং আর মিছিল আর গুলিবর্ষণ আর কারফ্যু-ভাঙ্গা আর গণআদালত - সব জায়গায় ফেটে পড়ে ক্ষোভ ও বিদ্রোহ। সব মানুষেরই হৃদয়ের অভিষেক ঘটে একটি অবিচল লক্ষ্যে - মুক্তি। মুক্তি? তার আসার পথও যে একরকম নয়। কারো স্লোগান, ‘দিকে দিকে আগুন জ্বালো’, কারো ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’। আরোপ করা সামরিক শাসনের নির্যাতন শুরু হলে বন্ধুরা যখন বিহ্বল, ওসমানের ডানায় তখন লাগে প্রবল বেগ। সহনামী কিশোরকে সে চুম্বনে রক্তাক্ত করে, বিকৃত যৌনতার বশে নয়, আত্মপ্রেমে পরাজিত হয়ে। ওসমান ‘একজন’। সে এক নার্সিসাস। কিন্তু এখানে তার শেষ নয়। নিজের খাঁচা থেকে বেরুবার জন্য তার ডানা ঝাপটানো পরিণত হয় প্রচন্ড ক্রোধে। রঞ্জুকে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়ার জন্য সে প্রানান্ত উদ্যোগ নেয়। এ কি তার আত্মপ্রেম বিসর্জনের প্রস্তুতি? পরিচিত সবাই ওসমানকে চিহ্নিত করে বদ্ধ পাগল হিসেবে। অনুরাগী বন্ধুরা তাকে বন্দী করে রাখে নিজের ঘরে। এখন এই বিচ্ছিন্ন ঘর থেকে ওসমানকে উদ্ধার করতে পারে কে? এক-নেতায় বিশ্বাসী আলাউদ্দিন? ভোটের রাইট-প্রার্থী আলতাফ? রাজনীতি-বিশ্লেষক বামপন্থী আনোয়ার? - না এরা কেউ নয়। চিলেকোঠার দুর্গ থেকে ওসমানকে বেরিয়ে পড়তে প্ররোচনা দেয় হাড্ডি খিজির যে নিজের বাপের নাম জানে না, যে বড় হয়েছে রাস্তায় রাস্তায়, যার মা বৌ দুজনেই মহাজনের ভোগ্য এবং গণঅভ্যুত্থানের সদস্য হওয়ার অপরাধে মধ্যরাতে কারফ্যু-চাপা রাস্তায় যে প্রাণদন্ডে দন্ডিত হয় মিলিটারির হাতে। নিহত খিজিরের আমন্ত্রণে ও আহ্বানে সক্রিয় সাড়া দিয়ে ওসমান ঘরের তালা ভাঙে। সবার অগোচরে সে বেরিয়ে আসে রাস্তায়, কারফ্যুর দাপট অগ্রাহ্য করে। তার সামনে এখন অজস্র পথ। পূর্ব পশ্চিম উত্তর দক্ষিণ - সব দিক তার খোলা। ওসমান যেদিকেই পা বাড়ায় সেদিকেই পূর্ব বাঙলা।
“সূর্য দীঘল বাড়ী বইটির”ফ্ল্যাপের কথাঃ উভয় বাংলার অল্পক’টি সার্থক উপন্যাসের মধ্যে সূর্য-দীঘল বাড়ী একটি। অনূদিত হয়ে বইটি বিভিন্ন বিদেশী ভাষায় প্রকাশিত হয়েছে। সূর্য-দীঘল বাড়ী অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র ছ'টি আন্তর্জাতিক এবং বিভিন্ন বিভাগে নটি জাতীয় পুরস্কার লাভ করে। তার ছােট গল্পগ্রন্থ ‘মহাপতঙ্গ 2039. The Dragonfly' (মহাপতঙ্গ) গল্প অবলম্বনে রচিত চিত্রনাট্য সুইজ্যারল্যান্ডে আন্তর্জাতিক প্রতিযােগিতায় পুরস্কার লাভ করে। হারেম’ নামে তার প্রথম ছােটগল্প-গ্রন্থটির ততীয় মুদ্রণ ১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয়েছে। তাঁর প্রথম মুদ্রিত গল্প ‘অভিশাপ' প্রকাশিত হয় ১৯৪০ সালে কবি কাজী নজরুল ইসলাম সম্পাদিত নবযুগ (কলকাতা)। পত্রিকায়। বইটির প্রথম অংশের কিছু কথাঃ তার বংশ ধ্বংস হয়। বংশে বাতি দেয়ার লােক থাকে না। গ্রামের সমস্ত বাড়ীই উত্তর-দক্ষিণ প্রসারী। | সূর্য-দীঘল বাড়ীর ইতিহাস ভীতিজনক। সে ইতিহাস জয়গুন ও শফির মা-র অজানা নয়। সে অনেক বছর আগের কথা। এ গ্রামের হাতেম ও খাদেম নামে দুই ভাই ছিল। ঝগড়া করে ভাই-ভাই ঠাই-ঠাই হয়ে যায়। খাদেম আসে সূর্য-দীঘল বাড়ীটায়। বাড়ীটা বহুদিন থেকেই খালি পড়ে ছিল। | এখানে এক সময়ে লােক বাস করত, সন্দেহ নেই। কিন্তু তারা বংশ রক্ষা করতে পেরেছিল কিনা কেউ জানে না। তবুও লােকের ধারণা, সূর্য-দীঘল বাড়ীতে নিশ্চয়ই বংশ লােপ পেয়ে থাকবে। নচেৎ এরকম বিরান পড়ে থাকবে কেন? যাই হােক, শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিষেধ অগ্রাহ্য করে খাদেম এসে সূর্য-দীঘল বাড়ীতে বসবাস আরম্ভ করে। কিন্তু একটি বছরও ঘুরল না। বর্ষার সময় তার একজোড়া ছেলে-মেয়ে পানিতে ডুবে মারা গেল। সবাই বুঝতে পারল-বংশ নির্বংশ হওয়ার পালা শুরু হল এবার। বুড়ােরা উপদেশ দিলেন বাড়ীটা ছেড়ে দেয়ার জন্য। বন্ধু-বান্ধবরা গালাগালি শুরু করল—আল্লার দুইন্যায় আর বাড়ী নাই তাের লাইগ্যা। সূর্য-দীগল বাড়ীতে দ্যা কি দশা অয় এইবার। | খাদেমের মনেও ভয় ঢুকে গিয়েছিল। সাতদিনের মধ্যে ঘর-দুয়ার ভেঙ্গে সে অন্যত্র উঠে যায়। জয়গুনের প্রপিতামহ খুব সস্তায়, উচিত-মূল্যের অর্ধেক দিয়ে তার কাছ থেকে বাড়ীটা কিনে নেয়। উত্তরাধিকারের সেই সূত্র ধরে জয়গুন ও শফি এখন এ বাড়ীর মালিক। | ঐ ঘটনার পর অনেক বছর পেরিয়ে গেছে। এতদিনের মধ্যে আর কোনাে লােক ভুলেও এ বাড়ীতে আসেনি। আকালের সময় জয়গুন ও শফির মা এ বাড়ীটাই বিক্রী করতে চেয়েছিল। কিন্তু সূর্য-দীঘল বাড়ী কেউ কিনতে এগােয়নি। তখন এ বাড়ীটা বিক্রী করতে পারলেও জয়গুনের স্বামীর ভিটেটুকু রক্ষা করা যেত; ছেলে-মেয়ের বাপ-দাদার কবরে আজ আবার বাতি জ্বলত। বহুদিনের পরিত্যক্ত বাড়ী। সর্বত্র হাঁটুসমান ঘাস, কচুগাছ, মটকা ও ভট-শেওড়া জন্মে অরণ্য হয়ে আছে। বাড়ীর চারপাশে গােটা কয়েক আমগাছ জড়াজড়ি করে আছে। বাড়ীর পশ্চিম পাশে দুটো বড়া বাঁশের ঝাড়। তা ছাড়া আছে তেঁতুল, শিমুল ও গাবগাছ। গ্রামের লােকের বিশ্বাস—এই গাছগুলােই ভূত-পেত্নীর আড্ডা। অনেকদিন আগের কথা। সন্ধ্যার পর গদু প্রধান সােনাকান্দার হাট থেকে ফিরছিল। তার হাতে একজোড়া ইলিশ মাছ। সূর্য-দীঘল বাড়ীর পাশের হালট দিয়ে যেতে যেতে সে শুনতে পায়—অই পরধাইন্যা, মাছ দিয়া যা! না দিলে ভালা অইব না। প্রথমে গদু প্রধান ভ্রুক্ষেপ করেনি। পরে যখন পায়ের কাছে ঢিল পড়তে শুরু করে, তখন তার হাত থেকে মাছ দুটো খসে পড়ে যায়। সে ‘আউজুবিল্লাহ্' পড়তে পড়তে কোনাে রকমে বাড়ী এসেই অজ্ঞান। রহমত কাজী রাত দুপুরের পর তাহাজ্জুদের নামাজ পড়বার জন্যে ওজু করতে বেরিয়ে ফুটফুটে জোছনায় একদিন দেখেছে—সূর্য-দীঘল বাড়ীর গাবগাছের টিকিতে চুল ছেড়ে দিয়ে একটি বউ দু’পা ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক দৃষ্টিতে সে চেয়ে দেখছিল। চোখের পলক ফেলে দেখে আর সেখানে বউ নেই। একটা ঝড়াে বাতাস উত্তর-পশ্চিম কোণাকুণি করম আলী হাজীর বাড়ীর ওপর দিয়ে চলে গেল। পরের দিনই করম আলী হাজীর.......
দহনকাল' ফ্ল্যাপে লেখা কথাঃ অদ্বৈত মল্লাবর্মণের (১৯১৪-১৯৫১) পরে দীর্ঘদিন আর কোনো জলপুত্র কলম হাতে তুলে নেননি। অদ্বৈতর মৃত্যুর ৪৯ বছর পর হরিশংকর জলদাস লিখতে শুরু করলেন। জেলেদের নিয়েই লেখালেখি শুরু করলেন তিনি। অদ্বৈত নদীলগ্ন মানুষদের জীবনকতা লিখে গেলেন, আর হরিশংকর লিখছেন সমুদ্রসংগ্রামী জেলেদের জীবনালেখ্য, তবে নদীমগ্ন মানুষজনও তাঁর কথাসহিত্যে অবহেলিত নয়। মূলত, হরিশংকর জলদাস জেলেসম্প্রদায়ের দিবারাত্রির কাব্য নির্মাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। ‘জলপুত্র’ ও ‘কৈবর্তকথা’র পর ‘দহনকাল’ লিখলেন তিনি। ‘দহনকালে’র কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছে বঞ্চিত-লাঞ্ছিত জেলেসম্পদায়, আছে তাদের প্রতিবাদ-প্রতিশোধ আর আছে মুক্তিযুদ্ধ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। হরিদাস নামের একজন জলপুত্র অশিক্ষিত বাবা রাধানাথের প্রেরণায় আলোর পথে হাঁটছে। তার পরিবারকে ঘিরে সমাজের পিছুটান, স্বার্থপরদের লোলুপতা, সুবিধাবাদীদের ওপর-চালাকি আবর্তিত হচ্ছে। নিকুঞ্জ সর্দার আবদুল খালেকের সঙ্গে মিলেমিশে রাধানাথ তথা গোটা জেলেসমাজকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়েছে। চন্দ্রকলা নামের বিধবা মহিলাটি শেষ পর্যন্ত এইসব অনাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামশীল থেকে গেছে। হরিদাস, রাধানাথ, খু-উ বুইজ্যা, রাধেশ্যাম, চন্দ্রকলা, পরিমল, রসমোহন, শিবশরণ এরা যেন জেলেসমাজের একা একটি স্বতন্ত্র কণ্ঠস্বর। এদের নিয়েই ‘দহনকালে’র কাহিনী বয়ন। এই উপন্যাসে দয়ালহরি বঞ্চনার শিকার হয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে আর রামহরি নিজের জীবন দিয়ে জালাল মেম্বারের সেই বঞ্চনার প্রতিশোধ নেয়। হরবাঁশি গানের ভেতর দিয়ে জগৎ ও জীবনকে অনুধাবন করতে চায়। সমুদ্রসংগ্রামী এবং নদীলগ্ন জেলেদের সঙ্গ-নৈঃসঙ্গ্য, মৃত্যু-জীবন একাকার হয়ে আছে ‘দহনকাল’ উপন্যাসে। দহনকালের মধ্য দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে জেলেরা একাত্তরের পাদদেশে এসে উপস্থিত হয়। নির্জীব, নির্বীর্য, নিথর উত্তর পতেংগার জেলেপল্লীটি পাকসেনাদের অত্যাচার-বর্বরতায় জেগে ওঠে। মা-বোন-স্ত্রীর ইজ্জত রক্ষা করবার জন্য হরিদাস-রাধেশ্যাম-খু-উ বুইজ্যারা হাতে অস্ত্র তুলে নেয় নিজেদের অজান্তে পরোক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে মুক্তিসংগ্রামে। জেলেদের জীবনে আরেক দহনকাল শুরু হয়।
প্রদোষে প্রাকৃতজন’ ফ্ল্যাপে লেখা কথাঃ সেনরাজার শাসন থেকে স্খলিত হয়ে যাচ্ছে দেশে, তুকী আক্রমণ অত্যাসন্ন। তবু সামন্ত মহাসামন্তদের অত্যাচারের শেষ নেই। সেই অত্যাচা রুখে দাঁড়ায় কখনো অন্ত্যজরা , কখনো বৌদ্ধেরা। শাসকদের বিশেষ রোষ তাই তাদর উপরেই । তাদেরই একজন প্রশ্ন করেন : ‘দেখো, এই কি মানুষের জীবন? সুখ নাই, স্বতি নেই, গৃহ নেই, কেবলি প্রাণ নিয়ে পলায়ন করতে হচ্ছে-এর শেষ কোথায়? এ জীবন কি যাপন করা যায়? বলো, কতো দিন এভাবে চলবে?’ ইতিহাসের সেই প্রদোষকালের জটিল আবর্তে ঘূর্ণ্যমান কয়েকজন প্রাকৃত নরনারীরির কাহিণী বিবৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। ইতিহাসে তাদের নাম নেই। হয়তো অন্য নামে তারা বাস করেছে সেই কালে, হয়তো অন্য কালেও। মৃৎশিল্পী শ্যামাঙ্গের যত্নকৃত শিল্প রজচনায় কেন ছেদ পড়ে, কিসের অন্বেষণে তাকে নিরুদ্দেশযাত্রা করতে হয়? স্বামী পরিত্যক্তা লীলাবতী কী চায়, কেন পায় না? মায়াবতীর কোমল বাহুবন্ধন ছিন্ন করে বসন্তদাস কেন মিত্রানন্দের সঙ্গী হয়? মানুষকে স্বপরিচয়ে উঠে দাঁড়াতে বলে মিত্রানন্দ, নতজানু দাসত্ব থেকে মুক্ত হতে বলে। এর বেশি সে জানে না, জানবার আবশ্যকতাও বোধ করে না। বসন্তদাসও চায় প্রচলিত ব্যবস্থা বিধ্বস্ত করতে, কিন্তু সে আরও জানতে চায় যে, তার পরিবর্তে কী পাবে সকলে? এসব প্রশ্নের মীমাংসা হবার আগেই ইতিহাসের ঝঞ্ঝা এসে তাদর সমূলে উৎপাটিত করে। কিন্তু এইসব জিজ্ঞাসা আর ভালোবাসা ,স্বপ্ন আর প্রয়াসের সারাৎসার তারা সঁপে দিয়ে যায় উত্তরসূরীদের হাতে। বড়ো যত্নের সঙ্গে শওকত আলী লিখেছেন তাদের কথা, সেই সময়ের কথা। গবেষণার সঙ্গে এই বইতে যুক্ত হয়েছে দরদ, তথ্যের সঙ্গে মিলেছে অন্তর্দৃষ্টি, মনোহর ভঙ্গির সঙ্গে মিশেছে অনুপম ভাষা। ‘প্রদোষে প্রাকৃতজন’ আমাদের উপন্যাসের ধারায় একটি স্মরণীয় সংযোজন।
‘শবনম’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথাঃ সৈয়দ মুজতবা আলীর এক অনবদ্য সৃষ্টি শবনম। কিন্তু শবনম কি উপন্যাস, নাটক না সৃষ্টিমুখর প্রেমকাব্য? রাধা-কৃষ্ণ কিংবা শিরি-ফরহাদের প্রেমের চিরায়ত ধারা শবৃনমূ-মজনুনের মাঝেও চিরবহমান সে-প্রেম অনন্ত-অনাদি। তাই শবনমের মুখ থেকে উচ্চারিত হয়। চিরমানবের অন্তর্বেদনা, “আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেয়ো না, আমার মিলনে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেয়ে না।” অনুভূত হয় “সর্ব চৈতন্যে, সর্ব কল্পনার যে মহান সত্তা তিনি তার বিশ্বরূপ ব্রহ্মাণ্ড স্বরূপের একটি মাত্র রূপ স্বপ্রকাশ করেছেন— মর্ত্যলোকে তাঁর প্রেমরূপ”। এভাবেই শবৃনম্ হয়ে ওঠে “শারদ-প্রাতে গন্ধবিধুর মাঠের শেফালি-বিছানো গালিচায় বিরহিনী নিশীথিনীর অশ্রুশিশির
‘সংশপ্তক’ বইয়ের ফ্ল্যাপের কথা সংশপ্তক বিগত যুগের কাহিনী। সংশপ্তক এ যুগের দর্পণ। সংশপ্তক ভাবীকালের কল্লোল। সংঘাতে বেদনায় ক্ষুব্ধ যে কাল সে কালের মানুষ দরবেশ, ফেলু মিঞা, জাহেদ, সেকান্দার মাস্টার, রামদায়াল, আশোক, রমজান আর মোজাদ্দেদী সাহেব। জীবনসংগ্রামে যারা আজও হাল ছাড়ে নি তাদেরই প্ৰতিভূ লেকু-কসির-হুরমতি। আর যারা ধরা পড়েছে যুগের দর্পণে, হার মেনেছে জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে অথবা ভাস্বর অগ্নিঝলকে, সেই রাবু, আরিফা, রানু, রিহানা কিংবা মালু, এরা সবাই মুখর ক্রান্তিলগ্নের উত্থান-পতনে, জীবনে জিজ্ঞাসার যন্ত্রণায়। যুগধারার ত্রিবেণী-সঙ্গমে এই নায়ক-নায়িকারা কেউ অসাধারণত্বের দাবিদার নয় কিন্তু এরা সবাই অনন্যসাধারণ। এরা ইতিহাস। সারেং বৌ এবং রাজবন্দীর রোজনামচা ইতিমধ্যেই শহীদুল্লা কায়সারকে সাহিত্যজগতে খ্যাতির আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছে। লেখকের নবতম উপন্যাস সংশপ্তক বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বল কীর্তিরূপে পরিগণিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
আবু ইসহাক শরীয়তপুর জেলার নড়িয়া থানাধীন শিবঙ্গল গ্রামে ১৩৩৩ সালের ১৫ই কার্তিক (১লা নভেম্বর, ১৯২৬) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৪২ সালে স্কলারশিপ নিয়ে ম্যাট্রিক এবং ১৯৪৪ সালে আই. এ পাশ করেন । এর ষোল বছর পর ১৯৬০ সালে করাচি (বর্তমান পাকিস্তান) থেকে বি.এ. পাশ করেন। দেশে বিভিন্ন দায়িত্বশীল পদে এবং বিদেশে কূটনৈতিক পদে তিনি কর্মরত ছিলেন। দেশের বাইরে আকিয়াব ও কলকাতায় বাংলাদেশ দূতাবাসে ভাইস-কনসাল ও ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সাহিত্যে বিশেষ কৃতিত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলা একাডেমি ১৯৬২-৬৩ সালে তাঁকে সাহিত্য-পুরস্কারে সম্মানিত করে। অন্যান্য পুরস্কারের মধ্যে ১৯৮১ সালে তিনি সুন্দরবন সাহিত্য পদক ও ১৯৯৭ সালে একুশে পদক লাভ করেন। তিনি ২০০৪ সালে মরণত্তোর রাষ্ট্রৃ প্রদত্ত স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। আবু ইসহাক বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল প্রতিভা। তাঁর রচিত উপন্যস ‘সূর্য-দীঘল বাড়ি’ একটি স্মরণীয় সাহিত্যকীর্তি।