যে কোন জীবনী গ্রন্থমালার বই নতুন প্রজন্মের পাঠকের কাছে সমাদৃত হয়- একাধিক কারণে। বইগুলো পাঠ করে পাঠক তার জ্ঞানপিপাসা মেটায় এবং তার অনুসন্ধিৎসু মনে জেগে ওঠে সেসব ব্যক্তিত্বের মনন ও সংগ্রামের আলেখ্য। বরেণ্য শিক্ষাবিদ, দার্শনিক ও আজন্ম সমাজবিপ্লবী সরদার ফজলুল করিমের জীবনালেখ্য এ কারণে পাঠককে আকর্ষণ করবে। লেখক ও পরিবেশবিদ মার্জিয়া লিপি সরদার ফজলুল করিম বেঁচে থাকাকালীন ২০১৩ সাল থেকে তাঁর দিনলিপি সম্পাদনার কাজ শুরু করেন এবং ২০১৫ সালে একুশের বইমেলায় প্রকাশ করেন সরদার ফজলুল করিম : দিনলিপি। এরই ধারাবাহিকতায় লেখক ২০১৭-র একুশের গ্রন্থমেলায় বের করেন সরদার ফজলুল করিম বইটি। গদ্যপদ্য প্রকাশনা তাদের জীবনী গ্রন্থমালা সিরিজের আওতায় ১৯২ পৃষ্ঠার এই বইটি প্রকাশ করে একটি প্রশংসনীয় কাজ করেছে এবং বলা বাহুল্য লেখক মার্জিয়া লিপি সম্পাদনার কাজটি পরিশ্রম ও দক্ষতার সঙ্গেই সম্পন্ন করেছেন। সরদার ফজলুল করিম (১৯২৫-২০১৪) কর্মপরিধি কেবল তাত্ত্বিকতায় সীমাবদ্ধ রাখেননি। সারা জীবন নির্লোভ-নির্মোহ থেকে বাম রাজনীতির মূলধারায় সরাসরি অংশ নিয়ে সমাজবদলের বিপ্লবী সংগ্রামে নিবেদিত ছিলেন। আজীবন অসম্মত ছিলেন আত্মসমর্পণে। ১৯৪৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন বিপ্লবের স্বপ্ন মাথায় নিয়েই। শুধু তাই নয়, পাকিস্তান রাষ্ট্রের ২৬ বছরের শাসনামলে সরদার ফজলুল করিমকে চার দফায় ১১ বছর কারাবন্দি থাকতে হয়েছে। পার্থিব প্রতিষ্ঠার আগ্রহ থেকে তিনি নিজেকে মোহমুক্ত রেখেছেন। “১৯৪৫ সালের শেষের দিকে তিনি কলকাতায় রওনা হন একটি স্কলারশিপের ইন্টারভিউর জন্য। কলকাতার রাইটার্স বিল্ডিং য়ে ইন্টারভিউ দেওয়ার পূর্বে সরদার ফজলুল করিম কমিউনিস্ট পার্টির হেড কোয়ার্টার্সে যান। সেখানে কমরেড মুজাফ্ফর আহমদ ও নৃপেন চক্রবর্তীকে বলেন, ‘আমি তো বিলেত যাচ্ছি ’। তিনি অনার্স ও এম.এ.-তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছেন এবং স্কলারশিপটা ছিল মুসলমান ছাত্র ও দর্শনশাস্ত্রের জন্য সংরক্ষিত। বিভিন্ন কথার প্রতিক্রিয়া এবং কথোপকথনের এক পর্যায়ে ইন্টারভিউ কার্ডটি ছিঁড়ে ফেলেন এবং কর্তব্য স্থির করেন দেশে থেকে দেশের জন্য কাজ করবেন। আলোচ্য বইটির ১৮ পৃষ্ঠায় বর্ণিত ঘটনাটি এযুগে একেবারেই বিরল। যেখানে আমরা সকলেই উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাত্রাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে থাকি, সেখানে অধ্যাপক ফজলুল করিম একেবারেই বিপরীত স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছেন। মোট ১৫টি অধ্যায়ে বিভক্ত আলোচ্য বইটি জ্ঞানতাত্ত্বিক সরদার ফজলুল করিমের জীবনীকে পাঠকের সামনে নিয়ে এসেছে। তাঁর মতো মনীষীর জীবন ১৯২ পৃষ্ঠায় বিশ্লেষণ করা একেবারেই অসম্ভব। তবু লেখক চেষ্টা করেছেন চুম্বক অংশগুলোকে একসঙ্গে সংকলন করতে। জীবনকথা, শিক্ষা, কর্মজীবন, পারিবারিক জীবন, রাজনীতি ও জেলজীবন, দর্শনচিন্তা এবং রাজনৈতিক ভাবনা, যাপিত জীবনে বিভিন্ন ব্যক্তিত্বের প্রভাব, মানবিক গুণাবলি, গণমাধ্যমের সাথে সম্পৃক্ততা ও লেখালেখি, গ্রন্থপঞ্জি, সম্মাননা, মৃত্যু ও সমকালীন প্রতিক্রিয়া, রচনানিদর্শন, কিছু উল্লেখযোগ্য উক্তি ও চিঠি শিরোনামের ১৫টি অধ্যায় পাঠককে নিয়ে যাবে ফজলুল করিমের মনন ও জীবনসংগ্রামের কাছে। আলোচ্য বইটির ৫৬ পৃষ্ঠায় ব্যক্তি সরদার ফজলুল করিম নিজের সম্পর্কে উচ্চারিত উদ্ধৃতি পড়লে আমাদের উপলব্ধিতে আসে মানুষ হিসেবে তিনি কতটা উঁচুতে ছিলেন। ‘‘আমি তো আসলে কেউ না। আমার নিজেকে তেমন কিছু মনে হয় না, আমি অতি সাধারণ মানুষ। সাধারণ মানুষই থাকতে চাই। কোনো পার্থক্য খুঁজে পাই না। আমি আমার নীতি ও আদর্শের সঙ্গে কখনো আপস করি নি।’’ ছাত্র-ছাত্রীদের তিনি প্রায়ই বলতেন, “তোমাদের এই যে পরীক্ষা তা কিন্তু পাসের জন্য নয়, সার্টিফিকেটের জন্যও নয়, জানার ও শেখার জন্যই পড়তে হবে।” সমাজ পরিবর্তনে সতত নিবেদিত এই কৃতি ব্যক্তিত্ব চিরায়ত গ্রীক দর্শনের গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থগুলো অনুবাদ করে বাংলাদেশের পাঠকমহলে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভ করেন। সেই ১৯৬৫ সালে প্লেটোর সংলাপ দিয়ে তাঁর আকর গ্রন্থমালা প্রকাশিত হতে শুরু করে। সবশেষে ২০১৩ সালে বের করেন নিজের আত্মজীবনীগ্রন্থ আমি সরদার বলছি। ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত দর্শনকোষ বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বাংলাভাষী পাঠকসমাজে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়েছে। এছাড়া প্লেটোর রিপাবলিক, এ্যারিস্টটল-এর পলিটিক্স, চল্লিশের দশকের ঢাকা, এঙ্গেলস-এর এ্যান্টি-ডুরিং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও পূর্ববঙ্গীয় সমাজ : আলাপচারিতায় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, রুশোর সোশ্যাল কনট্রাক্ট ইত্যাদি বইগুলো আমাদের সাহিত্য, ইতিহাস ও জ্ঞানচর্চায় বড় অবদান রেখেছেন। দর্শনকোষ বইটির ভূমিকায় লেখক সরদার ফজলুল করিমের উদ্ধৃিত উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতার কথা আমি জানি। তথাপি এক্ষেত্রে কিছু না করাকে নিজের মনে অপরাধ বলে বোধ হয়েছে। এই মানসিক বোধ থেকে এবং বন্ধুজনদের উৎসাহে কাজটি শুরু করি...পরিশেষে আবার বলি : কোন জ্ঞানকোষই সম্পূর্ণ নয়, কারণ জ্ঞানের শেষ নাই। জ্ঞানকোষ মাত্রই আমাদের মনে কিছু তৃপ্তি এবং অনেক অতৃপ্তি এবং অন্বেষার সৃষ্টি করে... ১৯৭৩ সালের ২৫ আগস্ট সরদার ফজলুল করিম এভাবেই পাঠকের কাছে নিজের বিনয় এবং সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরেন, যা আসলে তাঁর প্রজ্ঞার পরিচায়ক। উল্লেখ্য দর্শনকোষ-এর মোট তিনটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল, পাঠকের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে; এবং ১৯৯৫ সালের ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত একটি সংস্করণে বাংলাদেশের লোকদার্শনিক আরজ আলী মাতুব্বর’কে পাঠকের কাছে উপস্থাপন করেছিলেন সরদার ফজলুল করিম। সরদার ফজলুল করিম সম্পর্কে একটু আক্ষেপ ও লজ্জা নিয়েই বলতে হচ্ছে, এতবড় মানের একজন মনীষী-কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ‘অধ্যাপক’ পদে পর্যন্ত পদোন্নতি দেয় নি। অধ্যাপক করিম ১৯৮৫ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে ‘সহযোগি অধ্যাপক’ হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। অথচ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়েছিল ১৯৪৬ সালে দর্শন বিভাগে প্রভাষক পদে যোগদানের মাধ্যমে। ১৯৪৮ সালে চাকরী ছেড়ে কৃষক আন্দোলনে যুক্ত হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ রাজনৈতিক জীবন বেছে নিয়ে দীর্ঘ কারা নির্যাতন, আত্মগোপন করে কাটিয়ে দিয়েছেন পুরো পাকিস্তানি শাসনামল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেন স্বাধীনতার পর। চাকরির ধারাবাহিকতা রক্ষা সম্ভব হয় নি, এই অজুহাতে তাঁকে ‘অধ্যাপক’ পদ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। কি আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা! ভাবা যায়! পরিশেষে, জীবনীগ্রন্থ সম্পর্কে বলা যায়, মার্জিয়া লিপি তার সম্পাদিত বইটির ১২৭ পৃষ্ঠা থেকে মনীষী সরদার ফজলুল করিমের মৃত্যু-পরবর্তী প্রতিক্রিয়াগুলো সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। ‘আমাদের প্রগতির শেষ সরদার’ শিরোনামে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর মন্তব্য একেবারেই যথার্থ হয়েছে। জনাব চৌধুরী লিখেছেন, “তিনি ব্যক্তিগতভাবে যেমন সদালাপী ছিলেন, তেমনই তাঁর লেখার মধ্যে তা পাওয়া যেত। লেখার ধরনও ছিল খুব মর্মগ্রাহী। সরদার ভাইয়ের আরেকটি বিশেষ দিক ছিল : তিনি কারও লেখা পড়লে প্রশংসা করতেন। এটা কেউ করে না। একজন সরদার ফজলুল করিম আমাদের কাছে যে উত্তরাধিকার রেখে গেলেনÑতা আমাদের জন্য, প্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।... তাঁর মতো এমন জীবনব্যাপী অঙ্গীকারাবদ্ধ মানুষ আমাদের অতীতেও কম, ভবিষ্যতেও দুর্লভ থাকবে বলে ধারণা।”
মার্জিয়া লিপির জন্ম ১৯৭৩ সালের ১৫ অক্টোবরে কিশােরগঞ্জ জেলায়। মা : ফিরােজা আক্তার বাবা : মাে: মােয়াজ্জেম হােসেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভুগােল ও পরিবেশে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। ১৯৯৩ সালের দৈনিক ইত্তেফাক’ এ পরিবেশ বিষয়ক তার প্রথম লেখা প্রকাশিত হয়। পরিবেশবিদ মার্জিয়া লিপি বাংলাদেশ বনবিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় বেপজায় ছিলেন; বর্তমানে ইউএসএইড-এর প্রকল্পে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবস্থাপনা পরামর্শক পদে কর্মরত। লেখকের উপকূলে বিশেষত পৃথিবীর সর্ববৃহত্তম একক ম্যানগ্রোভ বন-সুন্দরবনে কাজ করার অভিজ্ঞতায় লেখা-প্রকাশনা- বাংলাদেশের উপকূল : পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য। প্রকাশিত গ্রন্থ : আমার মেয়ে : আত্মজার সাথে। কথােপকথন, জীবনীগ্রন্থ সরদার ফজলুল করিম।। সম্পাদিত প্রকাশনা- সরদার ফজলুল করিম : দিনলিপি, মা-দুই বাংলার সাহিত্য সংকলন। শিশু-কিশাের সংকলন- চিরদিন তােমার আকাশ, চাঁদ উঠেছে ফুল ফুটেছে, আমরা সবাই রাজা, পাখি সব করে রব।