ভূমিকা সঞ্জীবচন্দ্রের ‘পালামৌ' বাংলা সাহিত্যে বোধ করি সবচেয়ে মনোরম ও মধুর রচনা । ‘মনোরম’ শব্দটি প্রয়োগ করা উচিত কি না সন্দেহ ছিল, কিন্তু বঙ্কিমচন্দ্রের ‘সঞ্জীবনী সুধা' ও চন্দ্রনাথ বসুর সঞ্জীব-সাহিত্য-সমা লাচনা'য় সন্দেহের নিরসন ঘটল। দুজনেই রচনাটির মিষ্টতা ও মনোহারিতার উল্লেখ করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের মতে সঞ্জীবচন্দ্র প্রীতিপরবশ, চন্দ্রনাথ বসুর মতে পালামৌ “মিষ্টতা মনোহারিত্বে” উপন্যাসের সমতুল্য; রবীন্দ্রনাথ অন্যত্র সঞ্জীবচন্দ্র প্রসঙ্গে তাঁর হৃদয়ের মাধুর্যের উল্লেখ করেছেন। তিনজনেরই সাক্ষ্যে একই সত্যের স্বীকারোক্তি, সঞ্জীবচন্দ্রের হৃদয় মাধুর্যে পূর্ণ। সেই মধুর রস হৃদয় থেকে উদ্গত ও কল্পনায় পরিস্রুত হয়ে “পালামৌ” গ্রন্থখানিকে আবিষ্ট করে রেখেছে, ফলে পালামৌ বাংলা সাহিত্যের মধুরতম গ্রন্থে পরিণত। অন্য লেখকদের হৃদয়ে বিচিত্র রসের স্ফূর্তি হয়ে থাকে, তাই তাঁদের গ্রন্থেও বিচিত্র রসের প্রকাশ; সঞ্জীবচন্দ্রের হৃদয়ে কেবল মধুর রস, পালামৌ মাধুর্যস্বরূপ। এ গ্রন্থ ভালো লাগল না এমন কারো মুখে শুনি নি, এ গ্রন্থ যার ভালো না লাগবে তার হৃদয়ে মাধুর্য নেই। বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ দুজনকেই স্বীকার করতে হয়েছে যে প্রতিভার যোগ্য ফল সঞ্জীবচন্দ্র ফলিয়ে যেতে পারেন নি। বঙ্কিমচন্দ্ৰ বলেন, তার কারণ নিরুদ্যমতা, রবীন্দ্রনাথ বলেন গৃহিণীপনার অভাব। প্রকৃত কারণটা সঞ্জীবচন্দ্রের মাধুর্যময় প্রকৃতির সঙ্গে জড়িত। খাঁটি সোনায় অলংকার তৈরি হয় না, অলংকার তৈরি করতে হলে একটুখানি খাদ মিশিয়ে সোনাকে শক্ত করে নিতে হয়। সঞ্জীবচন্দ্রের হৃদয়ে সেই খাদটুকু মিশ্রিত হয় নি, তাই তাঁর নিখাদ-হৃদয় সংসারের বা সাহিত্যের কাজে তেমন করে লাগল না। বঙ্কিমচন্দ্র অগ্রজের নিরুদ্যমতা, আলস্যের বারংবার উল্লেখ করেছেন, সেই সঙ্গেই বলেছেন মাঝে মাঝে তাঁর প্রতিভার অগ্নিশিখা উজ্জ্বল হয়ে উঠত, তার পরেই আবার সেই পূর্ববৎ। এ সেই খাদের অভাব, যে খাদ সোনাকে শক্ত করে তুলে সংসারের কাজের উপযোগী করে তোলে। চন্দ্রনাথ বসু-লিখিত “সঞ্জীব-সাহিত্য-সমালোচনা” পড়লে বুঝতে পারা যাবে যে নিরুদ্যমতা এক বিচিত্র রূপ নিয়েছে সঞ্জীবচন্দ্রের আলোচনায়। তিনি কোনো সূত্রকে ঋজুভাবে অনুসরণ করে যেতে পারেন না, মাঝে মাঝে নানারকম উপসূত্র এসে পড়ে, সূত্র ছিন্ন হয়ে যায়, তার পরে হঠাৎ সচেতন হয়ে ওঠেন লেখক, তখন ছিন্ন সূত্রের খেই ধরে আবার চলতে শুরু করেন, গল্প হিসাবে তেমন আর জমে না, কিন্তু সব অভাববোধ পূর্ণ হয়ে যায় সঞ্জীব-হৃদয়ের মাধুর্যরসে। বস্তুত পালামৌ একটানা লিখিত হয় নি, এতটুকু রচনা, তবু নানা সময়ের ব্যবধানে যে লিখিত হয়েছে, তার কারণ একটানা লিখতে গেলে যে উদ্যমের আবশ্যক হয় সঞ্জীবচরিত্রে তা ছিল না। এ-সব সত্ত্বেও 'পালামৌ' বাংলা সাহিত্যে একখানি অতি শ্ৰেষ্ঠ গ্ৰন্থ।