"চিরায়ত রুশ সাহিত্য: শ্রেষ্ঠ রুশ গল্প" বইয়ের ভূমিকা: আধুনিক রুশ সাহিত্যের বিকাশের পূর্বে ইউরােপের সবচেয়ে গরিব দেশ ছিল রাশিয়া। কৃষিপ্রধান দেশ হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার কৃষকরা ছিলেন হতদরিদ্র। শ্রমজীবী মানুষের অবস্থা ছিল একই রকম। জার সম্রাটরা ছিলে সম্পূর্ণ স্বৈরতান্ত্রিক। তারা নিজেদের মতাে করেই মানুষের ভাগ্য নির্ধারণ করতেন। সাধারণের কথা ও ইচ্ছার কোনাে মূল্য ছিল না। জনগণের উর্ধ্বে ছিল রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রের উপর তাদের কোনাে কর্তৃত্ব ছিল না। সম্রাট নিজেই নিজের ক্ষমতা নির্ধারণ করতেন। তার সেই নির্দেশ সকলেই রাষ্ট্রীয় কর্তব্য হিসাবে মানতে বাধ্য হতাে। রাশিয়ার মানুষের ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়ে বিক্ষোভে রূপ নেয়। ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে রাশিয়ার মহান লেখকদের কবিতা, গল্প ও উপন্যাসে। তাদের লেখাগুলি সমাজের দলিল হিসাবে স্বীকৃত হয়েছে। এই ক্রান্তিকালেই জন্ম হয়েছে এমন সব কালজয়ী লেখকের, যারা বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে মহান লেখক হিসাবে স্বীকৃত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন আলেকজান্ডার পুশকিন, নিকোলাই গােগল, ইভান তুর্গেনিভ, লেভ তলস্তয়, আন্তন চেখভ প্রমুখ। তারা অত্যন্ত নিখুঁতভাবে সমাজের গভীরে প্রবেশ করেছেন। এবং অঙ্কন করেছেন মানবচরিত্রের দলিল। এই জন্যই রুশ ভাষার গল্প মানে হচ্ছে। বহু ঘটনার জটিল ক্রমবিকাশ এবং মনস্তাত্ত্বিক সংঘাতের উন্মােচন। একসময় রুশ ভাষার গল্প এদেশের ঘরে ঘরে পঠিত হয়েছে। সেই সুবাদে রাশিয়ার মহান লেখকরা পাঠকদের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছেন। সময়ের ক্রমবিবর্তনে তাদের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেয়েছে, কিন্তু মর্যাদা সামান্যও কমেনি। তবে রুশ ভাষার চর্চায় ভাটা পড়েছে। এখন রুশ ভাষার গল্প অনূদিত হয় না বলেই চলে। পুরােনাে লেখাগুলিই পাঠকদের সামনে ঘুরেফিরে আসে। | উনবিংশ শতকের একজন বিশ্ববরেণ্য গল্পকার হচ্ছেন আলেকজান্ডার পুশকিন। (১৭৯৯-১৮৩৭)। তিনি রুশ সাহিত্যের জনক হিসাবে পরিচিত। পনেরাে বছর । বয়সে তার প্রথম কবিতা ছাপানাে হয়েছে। কবিতাটি প্রকাশিত হবার পর পুশকিন। প্রতিষ্ঠিত সমালােচকদের কাছ থেকে ব্যাপক প্রশংসা লাভ করেন। সত্যিকার অর্থে তখন থেকেই পুশকিনের প্রতিভার বিস্ফোরণ ঘটে। কম বয়সে কবিতা লিখে যারা সুনাম অর্জন করেছেন, তাদের মধ্যে পুশকিন একজন। পুশকিনের ‘অড টু লিবার্টি কবিতাটি জারের শাসন নাড়িয়ে দেয়। তিনি প্রশাসনের রােষানলে পড়ে নির্বাসিত। হন। তখন কবিতা লেখায় বিরতি দেন এবং গল্প, উপন্যাস ও নাটক লেখার প্রস্তুতি নেন এবং সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। তাঁর রচিত প্রথম নাটকের নাম বােরিস গাে ডু নভ। পুশকিন ছিলেন নিজের আদর্শের প্রতি অবিচল। তিনি মনেপ্রাণে জার শাসনের অবসান চেয়েছেন। স্বৈরতান্ত্রিক শাসনের অবসান চেয়ে। আন্দোলনে যােগ দিয়েছেন। দুঃশাসনের প্রতিবাদ করে লিখেছেন বিচিত্র ধরনের লেখা। তার লেখা গল্প ও উপন্যাস বিশ্বসাহিত্যে অমূল্য সম্পদ হিসাবে টিকে রয়েছে। পুশকিনের Engene Onegen উপন্যাস ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে ১৮২৫ থেকে ১৮৩২ সালের মধ্যে। তার স্টেশনের ডাকবাবু (১৮৩১) গল্পটি সংগৃহীত হয়েছে ‘বেলকিনের গল্প’ গ্রন্থ থেকে।
ননী ভৌমিক ১৯২১ সালে জন্ম গ্রহণ করেন।ননী ভৌমিকের বাড়ি বর্তমান বাংলাদেশের রংপুর। রংপুর শহরে স্কুলে পড়তেন। রংপুর কলেজে থেকে আই.এসসি ও পাবনা সরকারি কলেজ থেকে বি.এসসি পাস করেন। অর্থাভাবে এম.এসসি পড়তে পারেননি। পরে বীরভূম জেলার সিউড়িতে চলে আসেন। বীরভূম ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী বিপ্লবী নিত্যনারায়ন ভৌমিক তার দাদা ।ননী ভৌমিক তরুণ বয়েসেই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং স্বাধীনতা পত্রিকায় সাংবাদিকের কাজ করতে শুরু করেন। ৪৬ সালের ভয়াবহ দাঙ্গার ভেতরেও নির্ভীকভাবে সংবাদ সংগ্রহ করে গেছেন তিনি। পরে তেভাগা আন্দোলনের খবর জোগাড় করেছেন গ্রামে গ্রামে গিয়ে যা স্বাধীনতা পত্রিকায় প্রকাশিত হত। তার এই অভিজ্ঞতা ভিত্তিক ছোটগল্প সংকলন 'ধানকানা'বের হয়। অরণি পত্রিকায় নিজের সাহিত্যচর্চা শুরু হয়। চৈত্রদিন তার অপর গ্রন্থ। ফ্যাসিবিরোধী প্রগতি লেখক সংঘ ও ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী সমিতির সদস্য ছিলেন। পরিচয় পত্রিকা সম্পাদনা করেছেন কিছুকাল। তার বিখ্যাত উপন্যাস ধুলোমাটি ধারাবাহিকভাবে পরিচয়ে বের হয়। ১৯৪৮ সালে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ হলে তিনি গ্রেপ্তার হন ও প্রেসিডেন্সি, বক্সা ইত্যাদি জেলে আটক থাকেন। ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি তিনি মস্কোর প্রগতি প্রকাশনের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে অনুবাদকের কাজ নিয়ে সোভিয়েত রাশিয়া যান। রুশ মহিলা স্বেতলানা'কে বিয়ে করে সে দেশেই থেকে যান। বহু রুশ সাহিত্যের অসামান্য বাংলা অনুবাদ তার হাত দিয়ে বেরিয়েছে। রাজনৈতিক সাহিত্য ছাড়াও অজস্র শিশু কিশোরদের গল্প, উপন্যাস অনুবাদ করেছেন। ফিওদোর দস্তয়েভ্স্কির বঞ্চিত লাঞ্ছিত, জন রীডের দুনিয়া কাঁপানো দশদিন, ল্যেভ তল্স্তোয়ের আনা কারেনিনা ইত্যাদি ছাড়াও বাংলা- রুশ- বাংলা অভিধান, ইউক্রেনের গল্প, সোনার চাবি, উভচর মানব ইত্যাদি। তবে অনুবাদের কাজ করতে গিয়ে নিজের মৌলিক লেখার কাজ ব্যহত হয়। সোভিয়েত মধ্যপ্রাচ্য ভ্রমন করে রিপোর্টাজ ধর্মী 'মরু ও মঞ্জরী' গ্রন্থটি লেখেন সেই অভিজ্ঞতা নিয়ে। তার সাহিত্যকর্মের জন্যে বঙ্কিম পুরষ্কার ও ১৯৮৮ সালে বিদ্যাসাগর-স্মৃতি পুরষ্কার দেওয়া হয় তাকে। ননী ভৌমিকের শেষ জীবন অবহেলা আর আর্থিক সমস্যায় কাটে। পুত্রের মৃত্যুতে মানসিক আঘাত ও স্মৃতিভ্রংশে ভুগতেন। ১৮ ডিসেম্বর ১৯৯৬ সালে তিনি রাশিয়াতেই পথ দুর্ঘটনায় মারা যান।