“প্রস্থানের আগে" বইটির ফ্ল্যাপে লেখা কিছু কথাঃ শিবশঙ্কর বসে আছে বারান্দায়, একাকী। অপরাহ্ণ। বয়স সাতষট্টি। জন্ম তার উন্মুল কৈবর্ত পরিবারে। নিষ্ঠা আর শ্রমে জীবনে সমৃদ্ধি এসেছে। সমৃদ্ধি কি জীবনের সকল বাসনা মিটিয়ে দিতে পারে ? তাহলে কেন আজ শিবশঙ্করের মনে হচ্ছে তার চারপাশে কেউ নেই ? সহােদররা নেই, কন্যা মৃত্তিকা নেই, পুত্র আকাশ নেই, এমনকি স্ত্রী সুলেখাও নেই। কিন্তু ওরা সবাই আছে, সবাই জীবিত। কেন শিবশঙ্করের এই একাকিত্ব ? শিবশঙ্কর নামের একজন অধ্যাপককে নিয়ে হরিশংকর জলদাসের উপন্যাস ‘প্রস্থানের আগে’। এ শুধু ব্যক্তিজীবনের উপাখ্যান নয়, একটা সামগ্রিক কালের, গােটা একটা কৈবর্তসমাজের কাহিনিও। এই উপন্যাসের পটভূমি গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত বিস্তৃত। পতিতাপল্লি, বৈষ্ণব আখড়া, রাতের শহর, স্বামীলাঞ্ছিত মৃত্তিকা, স্খলিত মঙ্গল-এ উপন্যাসের অনুষঙ্গ-কুশীলব। উপন্যাসটি পড়তে পড়তে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগবে সারা রাত অপূর্বকে দেহ দিয়ে বিচারসভায় কেন অস্বীকার করল শিউলি ? কেন শিবশঙ্কর পতিতা-সম্ভোগ-করে সাহেবপাড়া থেকে ফিরে এল ? কেন চৈতন্য খুড়ি ধর্ম ত্যাগ করল ? ভােলানাথ গােয়ালার মতাে সহজ মানুষটি কেন গলায় দড়ি দিল ? শিবু-প্রিয় কি শেষ পর্যন্ত জানতে পারল ভােলাকার আত্মহত্যার কারণ ? চন্দনা কে ? আকাশ কি বিয়ে করল শেষ অবধি ? মিটল কি শিবশঙ্করের বাসনা ? উপন্যাসের নাম প্রস্থানের আগেই-বা কেন ? এই উপন্যাসের ভাষা সহজ। ভারহীন,ভানমুক্ত। উপন্যাসের পরতে পরতে ঘটনার মােচড়। উল্লাস-আর্তনাদ, রিরংসা-জ্ঞাতিশত্রুতা, লােভ-হিংসা, প্রেম-বাৎসল্য উপন্যাসটির পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ‘প্রস্থানের আগে’ পাঠকের কাহিনি-তৃষ্ণা মিটাবে।
প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক হরিশংকর জলদাস ১৯৫৫ সালের ১২ই অক্টোবর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের উত্তর পতেঙ্গা গ্রামের এক জেলে পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা যুধিষ্ঠির জলদাস পেশায় ছিলেন একজন জেলে। ফলে আর্থিক অভাব অনটন আর অর্থনৈতিক টানাপোড়েনই ছিল হরিশংকরের বেড়ে ওঠার সঙ্গী। হরিশংকর জলদাসের শৈশব-কৈশোর কাটে পতেঙ্গার কৈবর্তপাড়ায়। তার বাবার স্বপ্ন ছিল ছেলেকে জেলের জীবনযুদ্ধে না জড়িয়ে শিক্ষিত করবেন যেন ছেলে সম্মানের জীবনযাপন করতে পারে। হরিশংকরের প্রাথমিক শিক্ষাজীবন শুরু হয় দেবেন্দ্রলাল দে’র আদাবস্যার নামের এক পাঠশালায়। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নিতে তিনি ভর্তি হন পতেঙ্গা বোর্ড প্রাইমারি স্কুলে। ১৯৭১ সালে পতেঙ্গা হাই স্কুল থেকে মাধ্যমিক পাস করেন। চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক সম্পন্ন করেন তিনি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে বাবার স্বপ্ন পূরণে আরো একধাপ এগিয়ে যান হরিশংকর। 'জাইল্যা' ঘরের সন্তান বলে তাকে বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হতে হয়েছে, শুনতে হয়েছে ‘জাওলার ছাওয়াল’ কটুক্তি। সেই কথার উচিত জবাব দিতে তিনি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে ‘নদীভিত্তিক বাংলা উপন্যাস ও কৈবর্ত জনজীবন’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এখানে তিনি জেলেদের জীবনের সকল আনন্দ-বেদনা, উৎপত্তি-বিকাশ, তাদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবন ইত্যাদি তুলে ধরেন। পেশাগত জীবনে হরিশংকর জলদাস চট্টগ্রাম সরকারি সিটি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান। কিন্তু কর্মজীবনের শুরুতে অভাবের দিনগুলোতে তিনি দিনে শিক্ষকতা এবং রাতে বাবার সাথে সমুদ্রে মাছ ধরতে যেতেন। ৪৭ বছর বয়সে তিনি তার প্রথম উপন্যাস ‘জলপুত্র’ লেখেন। এরপর, ক্রমাগত বাজারে আসতে থাকে হরিশংকর জলদাসের নতুন বই। হরিশংকর জলদাসের বইগুলোতে সবসময়ই উঠে এসেছে নিপীড়িত, প্রান্তিক এবং নিচুতলার মানুষের কথা। হরিশংকর জলদাসের উপন্যাসসমগ্র সমৃদ্ধ হয়েছে ‘আমি মৃণালিনী নই’, ‘হৃদয়নদী, ‘রামগোলাম’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ইত্যাদি চমৎকার উপন্যাসের মাধ্যমে। হরিশংকর জলদাসের ছোটগল্প ‘লুচ্চা’, ‘জলদাসীর গল্প’, ‘মাকাল লতা’ প্রভৃতিও পাঠকপ্রিয়। এছাড়া দুটি আত্মজীবনী রচনা করেছেন তিনি। ‘কসবি’, ‘দহনকাল’, ‘জলপুত্র’ হরিশংকর জলদাস এর সেরা বই। মধ্যবয়সে লেখা শুরু করলেও সাহিত্যকর্মে নতুন মাত্রা যোগ করায় তিনি বহু পুরস্কার অর্জন করেছেন। ২০১১ সালে ‘প্রথম আলো বর্ষসেরা পুরস্কার’ (দহনকাল), ২০১৩ সালে ‘আলাওল সাহিত্য পুরস্কার’ (জলপুত্র), ‘ব্র্যাক ব্যাংক-সমকাল সাহিত্য পুরস্কার’ (প্রতিদ্বন্দ্বী), ‘বাংলা অ্যাকাডেমি পুরষ্কার’, ‘সিটি আনন্দ আলো পুরস্কার’ সহ ভাষা ও সাহিত্যে অবদানের জন্য ২০১৯ সালে তিনি পেয়েছেন ‘একুশে পদক’।