তখন বাতাসের সঙ্গে নিরন্তর মিশে আছে বারুদের গন্ধ। দম নেয়া দায়। চারপাশে শুধু জার্মানদের বােমার উৎসব। সময়টা ইতিহাসে লেখা আছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নামে। ভয়াল সেই সময়ে ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ডে জন্ম নিলেন এক দেবশিশু। অপার্থিব এক আলােয় উজ্জ্বল হয়ে উঠল মা ইসাবেলার কোল। তখন কে জানত, এই শিশুর নাম একদিন অক্সফোর্ড পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়বে দুনিয়াজুড়ে? কে জানত এই শিশুর জ্ঞানের আলােয় আলােকিত হয়ে উঠবে সমগ্র বিশ্ব? কে-ই বা জানত, এই শিশু ইশকুলে পড়ার সময়েই পরিচিত হবেন। ‘আইনস্টাইন নামে? জীবদ্দশায় অনেক অকল্পনীয় বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন স্টিফেন হকিং। তার সম্পর্কে জানার আগ্রহর শেষ নেই মানুষের। কেমন ছিল এই অসামান্য বিজ্ঞানীর ছােটবেলা, বড়বেলা, যুবকৰেলা কিংবা শেষবার অক্সফোর্ড, কেমব্রিজের জীবনই-বা কেমন ছিল? কেমন ছিল মােটর নিউরন রােগে আক্রান্ত হয়ে হুইল চেয়ারে বন্দি জীবন? মৃত্যুর আগে তিনি নিজেই লিখে গেছেন সেসব ‘মাই ব্রিফ হিস্টি নামের আত্মস্মৃতি গ্রন্থে। হকিংয়ের সেই বই বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য নিয়ে এসেছেন জাহাঙ্গীর সুর। জাহাঙ্গীর সুরের ভাষান্তর নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। সাবলীল অনুবাদ, ভাষার মাধুর্য আর সহজিয়া গদ্যের সৌকর্য। দিয়ে ইতােমধ্যেই তিনি বিজ্ঞান অনুবাদ জগতে নিজস্ব স্থান করে নিয়েছেন। মাই ব্রিফ হিস্ট্রি'র বাংলা ভাষান্তর ‘আমার। এই ছােট্ট জীবন’-এর পাতায় পাতায় ধরা আছে সুরের মুন্সিয়ানা।
স্টিফেন উইলিয়াম হকিং একাধারে একজন তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী, মহাবিশ্ববিজ্ঞানী এবং লেখক। তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তাত্ত্বিক মহাকাশবিদ্যা বিভাগের পরিচালক এবং অধ্যাপক ছিলেন। বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম সেরা এই মেধাবী মানুষটির নাম শোনেননি, এমন পড়াশোনা জানা মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। স্টিফেন হকিং ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডে জন্মগ্রহণ করেন। স্কুলের পড়াশোনার পাট চুকিয়ে পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয়ে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। এরপর কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত মহাকাশতত্ত্ববিদ ডেভিড সিয়ামার তত্ত্বাবধানে পিএইচডি প্রোগ্রামে যোগ দেন। গ্যালিলিওর জন্মের ঠিক তিনশ বছর পর জন্ম নেওয়া এই বিজ্ঞানী তখন থেকেই তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ ঘটাতে থাকেন। পিএইচডি শেষ করার আগেই মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর জীবন আচমকা থমকে দাঁড়ায়। মোটর নিউরন রোগ বা এমায়োট্রফিক ল্যাটেরাল স্ক্লেরোসিস নামক এক বিরল রোগে আক্রান্ত হন হকিং। এই রোগে পেশি নাড়ানোর জন্য দায়ী নিউরনগুলোর মৃত্যু ঘটতে থাকে এবং শরীরের প্রায় সব অংশ অচল হয়ে যেতে থাকে। বাগদত্তা জেইন ওয়াইল্ড ও সুপারভাইজার সিয়ামার অনুপ্রেরণায় আশার সঞ্চার হয় তাঁর মাঝে। ঠিকমতো কলমটিও ধরতে না পারা এই বিজ্ঞানী ১৯৭৪ সালে বিজ্ঞানী রজার পেনরোজের সাথে তাঁর কালজয়ী ব্ল্যাকহোল তত্ত্ব প্রকাশ করেন, বর্তমানে যা হকিং রেডিয়েশন নামেও পরিচিত। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অফ আর্টস এর সম্মানিত ফেলো এবং পলিটিক্যাল অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সের আজীবন সদস্য ছিলেন। ২০০৯ সালে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরষ্কার ‘প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অফ ফ্রিডম’ খেতাবে ভূষিত হন। লেখক হিসেবেও হকিং বিস্ময়কর কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছেন। স্টিফেন হকিং এর বই সমূহ পাঠক সমাজে বিপুল জনপ্রিয়তা লাভ করেছে। তাঁর নিজের তত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে রচিত বই ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অফ টাইম’ দিয়ে তিনি ব্রিটিশ সানডে টাইমস এর বেস্ট সেলার তালিকায় ছিলেন টানা ২৩৭ সপ্তাহ। স্টিফেন হকিং এর রচনা সব ধরনের পাঠকদের কাছে জটিল বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা সহজভাবে জানার পাথেয় হিসেবে সমাদৃত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত এই বিজ্ঞানীকে ১৯৭৯ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসিয়ান অধ্যাপকের সম্মাননা দেওয়া হয়। ২০০৯ সালে তিনি এই পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। পাঠকনন্দিত স্টিফেন হকিং এর বই সমগ্র হলো ‘দ্য ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’, ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’, ‘মাই ব্রিফ হিস্ট্রি’, ‘দ্য থিওরি অফ এভরিথিং’, এবং ‘দ্য নেচার অফ স্পেস অ্যান্ড টাইম’। ২০১৪ সালে ইউনিভার্সাল পিকচার্স ‘দ্য থিওরি অফ এভরিথিং’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করে। এই সিনেমায় স্টিফেন হকিং এর ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য এডি রেডমেইন জিতে নেন অস্কার। শারীরিকভাবে ভীষণ রকম প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়েও হকিং তাঁর গবেষণা কার্যক্রম সাফল্যের সাথে চালিয়ে যান। ২০১৮ সালের ১৪ মার্চ ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।