শ্রেষ্ঠ গল্প, শ্রেষ্ঠ কবিতা, শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, কবির মুখ
‘শ্রেষ্ঠ গল্প' বইয়ের কথাঃ ততদিন আল মাহমুদ কবি হিসেবেই খ্যাত ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ পানকৌড়ির রক্ত বের হওয়ার পরপরই বাংলা সাহিত্য আরেকটি ঝাঁকুনি খায়। সমকালীন লেখক, পাঠক ও সমালোকরা নড়েচড়ে বসেন। তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থের পানকৌড়ির রক্ত ও জলবেশ্যা তো আজতক বাংলা সাহিত্যে এক ও অদ্বিতীয়ম। অনুভূতির এমন উত্তুঙ্গতা, ঘটনার এমন অভিনবত্ব, নির্মিতির এমন চমৎকারিত্ব বাংলা সাহিত্য আর দেখেনি। বর্তমান সংকলনটিতে সাহিত্যিক বিচেনায় যেসব গল্প ‘শ্রেষ্ঠ’ পদবাচ্য তার বাইরে গিয়েও একটি জনগোষ্ঠীর মাটি ও মানুষের গাল্পিক আল মাহমুদকে আবিষ্কারে চেষ্টা করা হয়েছে। এ আবিষ্কার কতটা সার্থক হয়েছে সে বিবেচনা পাঠকের। শ্রেষ্ঠ কবিতা' বইয়ের কথাঃ বাংলা কবিতায় আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠত্ব আজ আর অস্বীকার করার উপায় নেই। সমালোচকদের চোখে আল মাহমুদ জীবননান্দ দাশ পরবর্তী সবচেয়ে শক্তিশালী কবি। প্রায় পঞ্চাশ বছরের কবিজীবনে অসখ্য লিখেছেন এবং এখনও সমানে লিখে যাচ্ছেন। তার অধিকাংশ কবিতাই কালোত্তীর্ণ, স্বমহিমায় ভাস্বর। তাঁর প্রকাশিত প্রায় পঁচিশটি কবিতা ও ছড়াগ্রন্থ থেকে শ্রেষ্ঠ কবিতা বাছাই করা বেশ দুরূহ কাজ। সাধারণ পাঠকের কাছে তাঁর সব কবিতাই শ্রেষ্ঠ কবিতা বলে বিবেচিত হতে পারে। কবিতার ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ অভিধাটিই বিতর্কিত এবং কবির জন্য বিব্রতকরও বটে। তবুও সবকিছুর মতো কবিতারও মূল্যায়নে আসতে হয়। কোন কিছুর মানদণ্ড নির্ধারণে— হোক তা কবিতা বা শিল্পকলা—কে নির্ধারণ করছেন কিসের মানদণ্ডে নির্ধারণ করছেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এসব বিষয় মাথায় রেখেও বর্তমান গ্রন্থে আমরা মাহমুদের সমগ্রতা ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আল মাহমুদ কেন বাংলাদেশ ও বাংলা ভাষার গুরুত্বপূর্ণ কবি এ জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে গিয়ে স্বাভাবিকভাবেই আমাদের আধুনিকতাবাদী কাব্যরুচি থেকে বের হয়ে নতুনভাবে আল মাহমুদকে আবিষ্কার করতে হয়েছে। বর্তমান গ্রন্থটি এ আবিষ্কারেরই স্মারক। ‘শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ’ বইয়ের কথাঃ কাব্যপ্রেমিকগণ এক বাক্যেই স্বীকার করবেন যে, “আল মাহমুদ বাংলা সাহিত্যের সেরা কবিদের একজন”। কোনো কোনো বোদ্ধা পাঠক আবার আল মাহমুদকে জীবনানন্দ দাশ পরবর্তী বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে বড় কবি মনে করেন। গল্পকার, গদ্যশিল্পী হিসেবেও আল মাহমুদের তুলনা পাওয়া ভার। “সেরা আল মাহমুদ” নামে লিস্টে থাকা বইগুলো পাঠ করলেই পাঠকগণ তার প্রতিভার সঠিক মূল্যায়ন করতে পারবেন বলে আমাদের বিশ্বাস। ‘কবির মুখ’ বইয়ের কথাঃ আমি আমার নয় পুরুষের নাম জানি। এঁদের আগমন সম্পর্কে যেটুকু জানি, আমাদের বাড়িতে একটা কুরসিনামা ছিলো। তা থেকে আমি জানি যে এঁরা বাইরে থেকে এসেছিলেন। এঁরা সব ধর্মপ্রচারক। দিল্লিতে এসেছিলেন। রাষ্ট্রীয় উত্থান-পতনে এঁরা নানান দিকে ছড়িয়ে ছিটকে পড়েছেন। এঁদের মধ্যে ধর্মপ্রবণ একজন ভাটি অঞ্চলে চলে আসেন। এখানে থেকেছেন। এদেশের সাথে মিশে গেছেন।’—আল মাহমুদ একজন আল মাহমুদ যখন আত্মজীবনী লিখেন তখন একটি জনগোষ্ঠীর ইতিহাসই লেখেন। যার প্রমাণ ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’। গ্রন্থটি প্রথম যখন প্রকাশ হয় বোদ্ধাপাঠক মহলে বেশ সাড়া পড়ে যায়। কবিতা, গল্পের পর আত্মজীবনী রচনায়ও সাফল্য তার মুকুটে আরেকটি পালক যোগ করে। একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনী লেখার ইচ্ছা আল মাহমুদের বহুদিনের। কিন্তু বয়স ও স্মৃতিশক্তির কারণে এখন আর তা সম্ভব নয়। ফলে দুটি গ্রন্থ মিলিয়েই একটি হয়তো মাহমুদের একটি পূর্ণাঙ্গ আত্মজীবনীর কাছাকাছি যাওয়া যাবে। কেননা ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’-তে মাহমুদের জীবন সমাজ ও বাস্তবতার যেসব অধ্যায় অনুপস্থিত ছিল ‘বিচূর্ণ আয়নায় কবির মুখ’ গ্রন্থে যেসব তো উঠে এসেছে। আল মাহমুদের কবিতা ও ফিকশন তৈরির ক্ষমতা সম্পর্কে পাঠকমাত্রই জ্ঞাত। হুঁশিয়ার পাঠকগণ মাহমুদের আত্মজীবনীতে এই ক্ষমতার ভিন্ন প্রয়োগ দেখে চমৎকৃত হবেন।
বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ কবিদের একজন আল মাহমুদের কবিতার বই পড়েননি এমন সাহিত্যপ্রেমী খুঁজে পাওয়া ভার। গুণী এই কবি একাধারে একজন সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে গেছে তার কবি পরিচয়। আধুনিক বাংলা কবিতা নানা দিক থেকে তার কাছে ঋণী থাকবে। বাচনভঙ্গি আর রচনাশৈলীতে তার কবিতা সমকালীন যেকোনো কবির তুলনায় অনন্য। ‘কবিতাসমগ্র’ (দুই খন্ড) ‘উড়ালকাব্য’, ‘সোনালি কাবিন’, ‘আল মাহমুদের স্বাধীনতার কবিতা’, ‘প্রেমের কবিতা সমগ্র’, ‘আল মাহমুদের শ্রেষ্ঠ কবিতা’ ইত্যাদি কবিতার বই নিয়ে আল মাহমুদ কবিতাসমগ্র। এছাড়াও আল মাহমুদ উপন্যাস সমগ্র প্রকাশিত হয়েছে তিন খণ্ডে। জাতীয় রাজনীতি, অর্থনীতি, সামাজিক টানাপোড়েন, স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমি ও প্রেক্ষাপটসহ সমাজ ও ব্যক্তি জীবনের দ্বন্দ্ব স্থান পেয়েছে আল মাহমুদ এর বই সমূহ-তে। ‘কালের কলম’, ‘লোক লোকান্তর’, ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’, ‘আরব্য রজনীর রাজহাঁস’, ‘গল্প সমগ্র’, ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য লেখা। আল মাহমুদের জন্ম ১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মোড়াইল গ্রামে। তার পুরো নাম মীর আবদুস শুকুর আল মাহমুদ। শিক্ষাজীবনেই তিনি লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত হন। রবীন্দ্রনাথ, কাজী নজরুল আর মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী পাঠ করতে করতে নিজের কবি প্রতিভা আবিষ্কার করেন তিনি। ১৯৫৪ সালে সাপ্তাহিক কাফেলা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। কিছুকাল পরই এ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। পুরো ৬০-এর দশক জুড়ে তিনি অসংখ্য কবিতা রচনা করেন এবং কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও খ্যাতি লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রবাসী সরকারের হয়ে দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে দৈনিক গণকণ্ঠ পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। এ পত্রিকায় সরকার বিরোধী লেখালেখির কারণে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডও ভোগ করতে হয় তাকে। ১৯৭৫-৯৩ সাল পর্যন্ত শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক হিসেবে কাজ করে কর্মজীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কবি আল মাহমুদ তার অনবদ্য রচনাশৈলীর জন্য ‘বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার’, ‘একুশে পদক’, ‘জীবনানন্দ স্মৃতি পুরস্কার’, ‘নাসির উদ্দিন স্বর্ণপদক’ সহ অসংখ্য পদক ও সম্মাননা লাভ করেছেন। ২০১৯ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি তিনি পরলোকগমন করেন।