জুলি রহমানের ‘আয়নার যুদ্ধ’ শিরোনামের বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৯ সালের বইমেলায়। ‘আয়নার যুদ্ধ’ বইটি একটি গীতিকাব্যের গ্রন্থ। বর্তমান সময়ে এ ধরণের কাজ খুব একটা দেখা যায় না। গীতিকাব্য একজন কবির একান্ত ব্যক্তি-অনুভূতির সহজ, সাবলীল সঙ্গীত-মুখর জীবনের আত্ম-প্রতিফলন। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘বক্তার ভাবোচ্ছ্বাসের পরিস্ফুটন মাত্র যাহার উদ্দেশ্য, সেই কাব্যই গীতিকাব্য।’ গীতিকাব্য অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বলে সাধারণত দীর্ঘকায় হয় না। কারণ কোনো অনুভূতিই দীর্ঘকাল স্থায়ী নয়। কিন্তু কোনো কবি যদি গীতি কবিতায় তার ব্যক্তি-অনুভূতিকে একান্ত আন্তরিকতার সাথে অনায়াসে দীর্ঘকারে বর্ণনা করতে পারেন, তবে তার মূল রস ক্ষুণ্ন হয় না। কবির আন্তরিকতাই শ্রেষ্ঠ গীতিকবিতা বা গীতিকাব্যের একমাত্র নির্ণয়ক। ইংরেজি সাহিত্যে গীতিকাব্য লিরিক নামে অভিহিত হয়ে থাকে। জুলি রহমানের এ বইটির সূচিপত্রে রয়েছে- আয়নার যুদ্ধ, ঘরের ইঁদুর কাটে দাওয়া নাম যে রাজাকার, শিলারানির বিজয়, বিজয়বীথির কথা, নজরুলের জীবন কাহিনি, কাদম্বরী গীতিকাব্য, হ্যালো ও শাবানার প্রেম, বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের গীতি কবিতা, ডালিমন সুন্দরী, কলাবতী বৌ, বাংলা ভাষার গীতিকাব্য, জোহরা বাঈ, ঝরাপাতার কথা, নিউজার্সির সিক্স ফ্ল্যাগ, বাউলের একতারা, বৈশাখি বিকেলে, হ্যাপি নিউইয়র্ক বনাম ঢাকা। এছাড়া রয়েছে স্মৃতিকথা- বৈশাখের স্মৃতিচারণ-১, বৈশাখের স্মৃতিচারণ-২, শেষ হলো তিন দিনের বইমেলা। ‘আয়নার যুদ্ধ’ শিরোনামের কাব্যে কবি জুলি প্রেম ও মুক্তিযুদ্ধকে একসূত্রে গেঁথেছেন। এ কাব্যের শুরুতে তিনি লিখেন- ‘রূপ যেন বিধাতার অকৃপণ দান/সেই রূপে আয়নার বাড়ে সম্মান।/গরিবের ঘরে রূপ হলো অভিশাপ/আয়নার সুকর্মও হয়ে যায় পাপ।/...ভূমিহীনের কন্যা আয়না তার কেন রে রূপ?/জোতদার ব্যাটা মোড়ল চামার মারে ঝোপ বুঝে কোপ!/দাসীবাদী-বাঁদী আছে যত আরো লাগে তত/আয়নার মাকে খবর পাঠায় মাহিনা দিব শত!...একদিন যামিনী গভীর কালো হলো/আরমান তার পিস্তল আয়নাকে দিল।/বহু গুলির বিদীর্ণ রাজাকার মণ্ডলের দেহ/নির্জন বাড়িতে জানিল না কেহ।’ ১১০ পৃষ্ঠার এ বইটি জুলি রহমানের কাব্যশক্তির বিস্ফোরণ বলা যায়। কারণ এ ধরণের দীর্ঘ ও শ্রমসাধ্য কাজ করতে প্রচুর সময় ও মেধার দরকার হয়। সাহিত্যের পাঠকেরা এ ধরণের গীতিধর্মী কাব্যের স্বাদ অনেক দিন মনে রাখবেন কারণ ছন্দবদ্ধ লেখামাত্রই সহজে স্মরণযোগ্য।
জুলি রহমান মূলত কবি। ছেলেবেলার গান কবিতা মুড়ি-মুড়কির মতো উড়িয়ে দিতে দিতে কখন তা চলে এলো কলমের নিপুণ ডগায় তা হলফ করে বলাই মুশকিল। বস্তুত তারই দীঘল মাঠে আজো রয়েছেন তিনি কানায় কানায় পূর্ণ; সৃষ্ট কাব্যবাণী মাত্রার অভোগী প্রত্যয়ী হয়ে। তবে তিনি শিক্ষা জীবনের শুরু থেকেই ছিলেন মেধাবী। স্কুল কলেজে বিতর্ক প্রতিযোগিতা, ম্যাগাজিন, দেয়ালিকায় তার ভূমিকা মেজাজি, মেধাবী। শিক্ষা জীবন: ঢাকা পলিটেকনিক স্কুল, লালমাটিয়া কলেজ, তিতুমীর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম.এ করেন। স্বামী তখন প্রবাসী। তবে তার কচ্ছপী চলা বিরামহীন। শিক্ষা জীবনের সমাপ্তি টেনে একসময় স্বামী সংসারের মোহে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে পাড়ি জমান। কবি জুলি রহমান ধামরাই থানার চাপিল গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা মরহুম তজিম উদ্দিন মাতা ফাতেমা খাতুনের পঞ্চম সন্তান। পেশায় শিক্ষিকা জুলি রহমান একই সময় শিক্ষকতা ও শিল্প সাহিত্যচর্চার নিষ্ঠাত্রিপর্ণ প্রভায় তিনি হয়ে ওঠেন কাব্যকথা শিল্পবোধের সরসী মুকুর। সাহিত্যের নানা শাখা প্রশাখার চর্চাবর্তে তিনি নিজেকে করে চলেছেন পরিব্যাপ্ত। যার ফলশ্রæতিতে তার সৃষ্টি সৌকর্যে রূপায়িত হয়ে চলেছে সময়ের গল্প, কবিতা, উপন্যাস, প্রবন্ধ, নিবন্ধসহ গান গীতিকাব্য গীতিনাট্য ও পুঁথি! বাবার পুঁথিকে ধরে রাখার জন্যই তার প্রয়াস। বিবাহ পূর্বে তিনি দীর্ঘকাল ঢাকায় বিভিন্ন সাহিত্য সভাসহ পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি। স্বামীর সঙ্গে সুদূর মধ্যপ্রাচ্যে একটানা দশ বছর সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় অদম্য কাজ করেন। ধারাবাহিক উপন্যাস ‘যুদ্ধ ও নারী’, ‘বহে রক্তধারা’, ‘ব্যবধান’, ‘ফাতেমার জীবন’, ‘একজন দলিলুর রহমান’ ইত্যাদি সত্যের আলো পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। প্রকাশিত হয় গল্প-কবিতা রিয়াদ ডেইলিতে। রাইটার্সসহ জাগরণ রূপসি চাঁদপুর, ইত্যাদি লিটলম্যাগেও। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি সম্পাদনা করেন মধ্যপ্রাচ্যে ‘জলপ্রপাত’, ‘অনিবাস’, ‘রৌদ্দুরের’। কবির প্রকাশিত গ্রন্থ সংখ্যা সেই বিচারে প্রচুর নয়। মাত্র ২৫টি। তার উপন্যাস ও গল্প সমগ্র মুক্তির আকুতিতে অপেক্ষার ঘোলাজলে তর্পায়। কবিতা সমগ্র প্রস্তুতি পর্ব চলছে। অমর একুশে গ্রন্থমেলা-২০১৯শে প্রকাশ হচ্ছে ‘আয়নার যুদ্ধ’। এটি গীতিকাব্য। এ গ্রন্থের গীতিকাব্যগুলো সময়োপযোগী। স্বাধীনতার, বিজয়ের, বাংলা ভাষার, বৈশাখের, আমেরিকান কালচার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসের থ্যাংক্সগিভিং, সিক্সফ্লাগ্স, বাংলার শ্বাশ্বত চিরায়ত প্রেমের গীতিকাব্য নিয়ে ‘আয়নার যুদ্ধ’ বই। এই বইটির নামকরণে যিনি তিনি লেখকের বন্ধু আলেয়া চৌধুরী। জুলি রহমানের আরও প্রচুর গীতিকাব্য ও গান আছে, যা সংখ্যাতিত। যা এখনো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়নি। বর্তমানে তিনি সাজুফতা সাহিত্যক্লাবের পরিচালক এবং সাজুফতা নামে সাহিত্য-কাগজও সম্পাদনা করেন।