৬পৃষ্ঠা ভূমিকা সংবলিত বাঙালি মুসলমান সমাজে মানবতাবাদি সাহিত্যিকদের মধ্যে ডা. লুৎফর রহমান ছিলেন অন্যতম। উপদেশমূলক প্রাবন্ধিক হিসেবে সমসাময়িক বাংলা গদ্যকারদের মধ্যে তিনি বিশেষ খ্যাতি অর্জন করেন। ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে বর্তমান মাগুরা জেলার পারনান্দুয়ালী গ্রামে মাতামহ মুন্শী গোলাম কাদেরের গৃহে ডা. লুৎফর রহমান জন্মগ্রহণ করেন। এর আগে বিভিন্ন গবেষক ডা. লুৎফর রহমানের জন্মসাল বিভিন্নভাবে উল্লেখ করেছেন। তবে সম্প্রতি ডা. লুৎফর রহমানের পুত্র নিয়ামত উল্লাহ (জন্ম ১৯১৯)-এর হস্তালিখিত সংক্ষিপ্ত জীবনীতে ডা. লুৎফর রহমানের জন্মসাল ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ বলে উল্লিখিত হয়েছে। ঐ পা-ুলিপিতে ১৯১৫ খ্রিস্টাব্দকে তাঁর এন্ট্রান্স পাসের সাল বলা হয়েছে। অর্থাৎ লুৎফর রহমান আঠার বছর বয়সে এন্ট্রান্স পাস করেন। ডা. লুৎফর রহমান হোমিওপ্যাথী চিকিৎসা করে ‘ডাক্তার সাহেব’ নামে জনসাধারণের মাঝে ব্যাপক পরিচিত লাভ করেছিলেন এবং তাঁর প্রকাশিত রচনায় তিনি নিজে এই ‘ডাক্তার’ অভিধাটি তাঁর নামের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে তাঁর নাম ছিল জরদার লুৎফর রহমান। তিনি ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ নিজ গ্রাম হাজীপুরে পরলোকগমন করেন। ডা. লুৎফর রহমানের সাহিত্য ও কর্মজীবনকে মোটামুটি চার পর্বে ভাগ করা যায়। ১. সিরাজগঞ্জ পর্ব (১৯১৭-১৯১৮), ২. চট্টগ্রাম পর্ব (১৯১৮-১৯২০), ৩. কলকাতা পর্ব (১৯২০-১৯২৬) ও ৪. মাগুরা পর্ব (১৯২৬-১৯৩৬)। তিনি বস্তুনিষ্ঠ লেখার দিকে বেশি মনোযোগী ছিলেন। মানব জীবন, ধর্ম জীবন, উন্নত জীবন, উচ্চ জীবন, যুবক জীবন, মহা জীবন ও মহৎ জীবন নামক প্রবন্ধগুলোই তার ইঙ্গিত বহন করে। এছাড়া তিনি পথহারা, রায়হান, বাসর উপহার, প্রীতি উপহার ও রানী হেলেন-এর মতো উপন্যাসও লিখেছেন। উপন্যাস ছাড়াও তার বেশকিছু ছোটগল্প পাঠকসমাজে সমাদৃত। এ গ্রন্থে ডা. লুৎফর রহমানের প্রবন্ধ, উপন্যাস, গল্প ও অগ্রন্থিত রচনা মিলে ২৫টি লেখা স্থান পেয়েছে। প্রবন্ধ - ৭টি, উপন্যাস - ৫টি, গল্প - ৭টি এবং অগ্রন্থিত রচনা - ৭টি।
মোহাম্মদ লুৎফর রহমান তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার (বর্তমান মাগুরা জেলা) পরনান্দুয়ালী গ্রামে ১৮৮৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার মাতা শামসুন নাহার এবং পিতা সরদার মইনউদ্দিন আহমদ, যিনি একজন স্টেশন মাস্টার ছিলেন। এই দম্পতীর চার পুত্র ও এক কন্যার মধ্যে মোহাম্মদ লুৎফর রহমান একজন। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল তৎকালীন যশোর জেলার মাগুরা মহাকুমার হাজীপুর গ্রামে। লুত্ফর রহমানের পিতা ছিলেন এফ.এ পাস। ইংরেজি ভাষা ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রতি তার পিতার অনুরাগ ছিল। সম্ভবত একারণেই পিতার অনুরাগ লুৎফর রহমানের মাঝে প্রতিভাস হয়েছিল। নারী সমাজের উন্নতির জন্য নারীতীর্থ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান গঠন এবং নারীশক্তি নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন তিনি এবং একজন চিন্তাশীল ও যুক্তিবাদী প্রাবন্ধিক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন। তার প্রবন্ধ সহজবোধ্য এবং ভাবগম্ভীর। মহান জীবনের লক্ষ্য সাহিত্যের মাধ্যমে মহান চিন্তাচেতনার প্রতি আকৃষ্ট হতে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করেছেন তিনি। গভীর জীবনবোধ, মানবিক মূল্যবোধ, উচ্চ জীবন, সত্য জীবন, মানব জীবন, সূহ্ম বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গি তার রচনার প্রসাদগুণ। প্রবন্ধ ছাড়াও তিনি কবিতা, উপন্যাস ও শিশুতোষ সাহিত্য রচনা করেছেন। এফ.এ অধ্যয়নকালীন সময়ে লুৎফর রহমান তার নিজ গ্রাম হাজীপুরের 'আয়েশা খাতুন' নামে এক মহিলা সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। আয়শা খাতুনের পিতা মোহাম্মদ বদরউদ্দীন এ সময়ে মুন্সীগঞ্জ রেলওয়ের বুকিং ক্লার্ক ছিলেন। লুৎফর রহমানের সাহিত্য সাধনা শুরু হয়েছিল মূলত কবিতা রচনার মাধ্যমে। ১৯১৫ সালে চল্লিশটি কবিতা নিয়ে তার প্রথম এবং একমাত্র কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ প্রকাশিত হয়। পরে তিনি বিভিন্ন প্রবন্ধ, উপন্যাস, ছোটগল্প, কথিকা, শিশুতোষ সাহিত্য ইত্যাদি রচনা করেছেন। তার কিছু অনুবাদ কর্মও পাওয়া যায়। চরম দারিদ্রের মুখোমুখি যক্ষায় আক্রান্ত হয়ে মানবতাবাদী সাহিত্যিক ডাক্তার লুৎফর রহমান ১৯৩৬ সালের ৩১ মার্চ ৪৭ বৎসর বয়সে বিনা চিকিৎসায় নিজ গ্রাম মাগুরার হাজিপুর গ্রামে মৃত্যুবরন করেন