Quzi Imdadul Huq- (১৮৮২-১৯২৬) কর্মজীবনে ছিলেন শিক্ষক ও শিক্ষক-প্রশিক্ষক এবং শেষকালে ঢাকা মাধ্যমিক বোর্ডের প্রথম সেক্রেটারি। ভারতী ও নবনূর পত্রিকার তিনি নিয়মিত লেখক ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক। তাঁর প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ কবিতাসংগ্রহ আঁখিজল (১৯০০)। তাঁর শেষ রচনা আবদুল্লাহ্ উপন্যাসের ৩০ পরিচ্ছেদ পর্যন্ত তিনি লিখতে পেরেছিলেন। তাঁর অকালমৃত্যুর পরে আনোয়ারুল কাদীর বাকি ১১ পরিচ্ছেদ রচনা করেন মূল গ্রন্থকারের খসড়া-অবলম্বনে। তবে আবদুল কাদীর বলেছেন, তাঁদের দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশেষ পার্থক্য ছিল: ইমদাদুল হক ছিলেন মূলত সমাজচিত্রী, আর আনোয়ারুল কাদীর প্রধানত মনস্তাত্ত্বিক। তাই দুজনের লেখাতেও বিশেষ পার্থক্য ঘটেছে। বিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে লেখা আবদুল্লাহ্্ উপন্যাস বাঙালি মুসলমানের সমাজচিত্র হিসেবে মূল্যবান। চিত্রাঙ্কণের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে লেখকের সমাজ-সমালোচনা। যা ক্ষয়িষ্ণু, যা অসংগত, যা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তাকেই লেখক প্রবলভাবে আক্রমণ করেছেন। ওয়াহাবিদের গোঁড়ামির ছাপবর্জিত হলেও তাঁদের পিউরিট্যানিক মনোভাব যে ইমদাদুল হককে প্রভাবান্বিত করেছিল, তাতে সন্দেহ নেই। আবদুল্লাহ (১৯৩৩) উপন্যাসে বাঙালি মুসলমান সমাজের যেসব সমস্যার প্রতি আলোকপাত করা হয়েছে, পিরবাদ তার মধ্যে প্রথম। আবদুল্লাহ্ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, ধর্মপ্রাণ, কিন্তু কুসংস্কারবিরোধী। তার মতে, পির-মুরিদি ব্যবসাটা হিন্দুদের পুরুতগিরির অনুকরণ, ইসলামে তার স্থান নেই। কাসেম গোলদারের বাড়িতে নিজের পিতৃপুরুষের অলৌকিক ক্ষমতার গল্প শুনে তার মনে বিস্ময় জাগে: ‘পুত্রের পীরত্বে পিতার হৃদয়ে এরূপ সাংঘাতিক হিংসার উদ্রেক আরোপ করিয়া ইহারা পীর-মাহাত্ম্যের কি অদ্ভুত আদর্শই মনে মনে গড়িয়া তুলিয়াছে’ পির হওয়ার সহজ পথ ত্যাগ করে আবদুল্লাহ্ চাকরি করে উপার্জন করতে প্রবৃত্ত হয়েছে। আশরাফ-আতরাফভেদ আরেক সামাজিক সমস্যা। সৈয়দ সাহেবের মাদ্রাসায় এদের পাঠদানের বৈষম্য দেখে আবদুল্লাহ্ বিস্মিত হয় এবং মৌলভী সাহেবকে তার কারণ জিজ্ঞাসা করে। মৌলভী সাহেব জানান, আতরাফ সন্তানেরা তো মিয়াদের সমান চলতে পারে না, তাই সৈয়দ সাহেব এই বিষম শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছেন। আবদুল্লাহ্ যখন বলে, একেবারেই যদি তাদের পড়ানো না হয়, তাহলে কি আরো ভালো হয়ন না?, মৌলভী সাহেব তখন বলেন, গরিবেরা যখন শিকতে চায়, তখন তাদের একেবারে নিরাশ করলে খোদার কাছে কী জবাব দেবেন, তাছাড়া গোম্রারে এলেমদান করলে অনেক সওয়াব হয়, একথা কেতাবে আছে। এই সমস্যার চরম অভিব্যক্তি দেখা যায় মসজিদের ইমাম জোলা বলে যখন সৈয়দ সাহেব তাঁর পিছনে নামাজ পড়তে অস্বীকার করেন, তখন। এমনকী সুফী সাহেব পর্যন্ত সৈয়দ সাহেবের এমন বংশাভিমান সম্পর্কে কোনো কথা বলেন না। এই অশিষ্টতার বিরুদ্ধে আবদুল্লাহ্ এক মূর্তিমান প্রতিবাদ-সে জোলা ইমামের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। বংশমর্যাদা-প্রসঙ্গে মীর সাহেবের কথায় আবদুল্লাহ্র মনোভাবই প্রতিধ্বনিত হয়েছে: ‘কবরের ওপারের দিকে তাকাবার আমি কোন দরকার দেখি নে।’ পর্দাপ্রথার শ্বাসরুদ্ধকর কড়াকড়ির বিরুদ্ধেও আবদুল্লাহ্ সাহস করে দাঁড়িয়েছে। পল্লীসমাজের পরনিন্দা-প্রবৃত্তি এবং খাতকের প্রতি মহাজনের অত্যাচারের চিত্র-উদঘাটনে কাজী ইমদাদুল হক অকুণ্ঠ। হিন্দু-মুসলমান-বিরোধের পর্যালোচনাও তিনি করেছেন, সেখানে তিনি দায়ী করেছেন সম্প্রদায়কে নয়, ব্যক্তিকে। লেখক বুঝিয়ে দিয়েছেন, সকল সামাজিক মূঢ়তা ত্যাগ করে শিক্ষার আলোকে হয়েই তবে সাজকে সচল ও সজীব রাখা যাবে। বর্তমান মুদ্রণে আবদুল কাদির-সম্পদিত ও কেন্দ্রীয় বাঙলা-উন্নয়ন-বোর্ড-প্রকাশিত কাজী ইমদাদুল হক রচনাবলী (১৯৬৮) প্রথম ক-ের পাঠ অনুসৃত হয়েছে। -আনিসুজ্জামান জানুয়ারি ২০০৯