"কসদুস সাবিল" বইয়ের সংক্ষিপ্ত কথা: পীর’ শব্দটি এখন সাধারণের নিকট একটি ভিন্ন উপখ্যান। এ উপখ্যান মোটেও সুখকর নয়। ইসলামের বিরুদ্ধে আধুনিক মিডিয়ার বিরামহীন প্রোপাগান্ডা, ‘পীর’ নামে ভণ্ডদের বিশৃঙ্খল কর্মকা- এবং সর্বোপরি মানুষের দ্বীন সম্পর্কে অজ্ঞানতা ও অনভিজ্ঞতা শরীয়তের এই অবিচ্ছেদ্য ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে বিতর্কিত করে ফেলেছে। অথচ ব্যক্তির আত্মশুদ্ধি অর্জনে একজন ‘পীরের’ ভূমিকা অনস্বীকার্য। আত্মশুদ্ধি অর্জন করা প্রত্যেক মুসলিমের জন্য ফরয। এজন্য আল্লাহওয়ালাদের সোহবতে যেতে হয়, তাদের নিকট বাইআত হতে হয়। যেসব মহান ব্যক্তিগণ মানুষের আত্মা পরিশুদ্ধ করার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন, তারা আমাদের সমাজে ‘পীর’ নামেই পরিচিত। এজন্য পীরদের সম্পর্কে সম্যক পরিচয় লাভ করা জরুরী। এ পরিচয়লাভের ব্যাপারটিও জটিল। এই জটিল কাজকেই সহজ করে দিয়েছেন হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ.। তিনি এ-বিষয়ে কসদুস সাবিল নামে একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব রচনা করেছেন। পীর-মুরীদির উদ্দেশ্য, কামেল পীরের পরিচয়, তার সান্নিধ্যের গুরুত্ব ও ধরন, দৈনন্দিন অযীফা এবং সর্বোপরি তাসাওউফের সারনির্যাস এখানে তুলে ধরা হয়েছে। উলামায়ে কেরাম যেমন ইলমে হাদীস, তাফসীর, ফিকহ ইত্যাদি চর্চা করেন, তেমনি তারা তাযকিয়া ও তাসাওউফের চর্চাও করেন। এটি কুরআন-হাদীসেরই একটি শাখা। শায়খুল হাদীস মাওলানা যাকারিয়া রহ. তার আপবীতী গ্রন্থে বলেন, ‘কালক্রমে এ (তাসাওউফ)-শাস্ত্রে বিদআত ও কুপ্রথার যে সংমিশ্রণ ঘটেছিল, আকাবিরগণ এসব থেকে মুক্ত করে শাস্ত্রকে মূল অবয়বে দুনিয়াবাসীর সামনে প্রকাশ করেছেন। অনেক অজ্ঞ লোক তাসাওউফকে শরীয়তের বাহ্যিক বিধিনিষিধের পরিপন্থী মনে না করলেও বিচ্ছিন্ন তো অবশ্যই মনে করেন। নিঃসন্দেহে এটি বাড়াবাড়ি ও মূর্খতা বৈ কিছু নয়।’ কসদুস সাবিল কিতাবটি এ অভিসন্দর্ভে একটি অবশ্যপাঠ্য কিতাব।
হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং এর গন্ডি পেরিয়ে যিনি হাজারো মানুষকে দিয়েছেন আত্মশুদ্ধি ও তাসাওউফ এর শিক্ষা। যার কারণে তাঁর উপাধি ছিলো ‘হাকীমুল উম্মাত’ বা উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক। উপমহাদেশে মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারে তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ‘দাওয়াতুল হক’ এর অবদানের জন্যও প্রসিদ্ধ মাওলানা আশরাফ আলী থানভীর নাম। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে (রবিউস সানী ৫, ১২৮০ হিজরী) ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবেই হাফেয হোসাইন আলী রাহ.-এর কাছে সম্পূর্ণ কুরআন মুখস্থ করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাঁর শিক্ষাজীবন। নিজগ্রামেই ছোটবেলায় হযরত মাওলানা ফতেহ মুহাম্মদ থানভী রাহ.-এর কাছ থেকে আরবি ও ফার্সি ভাষার প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। ১২৯৫ হিজরীতে তিনি দারূল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চতর শাখাগুলোয় বিচরণ করার আগ্রহে। সেখানে তিনি পাঁচ বছর হাদীস, তাফসীর, আরবি সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস বিষয়ে অধ্যয়ন করেন। দেওবন্দে শিক্ষার অধ্যায় সমাপ্ত করে মক্কা মুকাররমায় মুহাম্মাদ আবদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর কাছে কেরাত ও তাজবীদ শেখেন। তিনি কানপুরের একটি মাদ্রাসায় মাত্র ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষকের পদ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। পরে কানপুরের টপকাপুরে জামিউল উলূম মাদ্রাসার প্রধান পরিচালকের আসন অলংকৃত করেন এবং দীর্ঘ ১৪ বছর সেখানে শিক্ষকতা করেন। পরবর্তীতে তাঁর শিক্ষক হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কীর রহ. পরামর্শে তিনি থানা ভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেন। সারা জীবনে আশরাফ আলী থানভী এর সকল বই এর হিসেব করতে গেলে ছোট-বড় মিলিয়ে তা সাড়ে বারো হাজার ছাড়িয়ে যায়। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমূহ এর মধ্যে ফিকাহ বিষয়ক বই ‘বেহেশতী জেওর’ উপমহাদেশের মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দু তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআনও (কুরআনের ব্যাখ্যা) এর ভাষা ও ব্যখ্যাশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ। হাকীমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রহ. এর বই সমগ্র এর স্বত্ত্ব তিনি জাতির কল্যাণে উন্মুক্ত করে রেখে গেছেন। জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে (১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী) আল্লামা থানভী রহ. তাঁর জন্মস্থান থানা ভবনেই মৃত্যুবরণ করেন।