চেয়ারে হেলান দিয়ে ইশতিয়াক একটু হাসলো। এখন সে অবসন্ন। ক্লান্তির কুয়াশা তার ওপর দিয়ে ভেসে যাচ্ছে। এই অবসাদ স্নায়ুকে তেমন বিপর্যস্ত করে না, বরং উপভোগ্য হয়ে ওঠে। এজন্যেই কি হাসলো ইশতিয়াক? এই অবসাদ উপভোগের কথা ভেবেই কি তার ঠোঁটে জেগে উঠেছে হাসির কুঁড়ি? না। ইশতিয়াক মৃদু মৃদু হাসছে সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে। এই মাত্র একটি উপন্যাস শেষ করেছে সে। অনেকদিন ধরে লিখছিল, প্রায় তিন বছরের শ্রমে গড়ে উঠেছে রাশি রাশি অক্ষরের একটি ভুবন। ইশতিয়াকের মনোজ ভুবন। হ্যাঁ, ইশতিয়াক হোসেন একজন লেখক। হেঁজিপেঁজি কেউ নয়। ইতোমধ্যেই তার বেশ নাম-ডাক হয়েছে। ভাগ্য তার প্রতি সুপ্রসন্নই, বলা যায়। খুব বেশি রগড়াতে হয়নি তাকে, প্রকাশকদের দোরে ধরনা দিতে দিতে জুতোর সোল ক্ষয় করেনি সে। একটি বিখ্যাত সাপ্তাহিকের ঈদ সংখ্যায় তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই একজন প্রকাশক ইশতিয়াক হোসেনের লেখা সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে ওঠেন, উপন্যাসটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের জন্যে রীতিমতো ব্যাকুলতা প্রকাশ করেন। খুব কম লেখকের বেলায় এ রকমটি হয়। এখন সে নামজাদা লেখক। রুচিশীল পাঠকগোষ্ঠি তার লেখা পছন্দ করে। সমালোচকদেরও নেক নজর পড়েছে তার ওপর। কিন্তু ইশতিয়াক হোসেনকে কিছুতেই জনপ্রিয় উপন্যাসকার বলা যাবে না। তিরিশ দিনে তিনটি উপন্যাস লিখে ফেলার তেলেসমাতি ক্ষমতা নিয়ে সে জন্মায়নি।
নরসিংদী জেলার রায়পুরা থানা থেকে আরেকটু ভেতরে মেঘনাপাড়ের গ্রাম পাড়াতলী। কবি শামসুর রাহমানের পৈতৃক নিবাস। তবে জন্মেছিলেন ঢাকা শহরের ৪৬ নম্বর মাহুতটুলির বাড়িতে। তারিখ ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। দশ ভাইবোনের মধ্যে জেষ্ঠ্য তিনি। ১৯৪৮ সালে যখন তার বয়স মাত্র ১৯ বছর তখন মননের গহীন তল্লাটে কবিতার যে আবাদভূমি গড়ে উঠেছিল, তা কেবল উর্বরই হয়েছে। যার ফলশ্রুতিতে নলিনী।কিশোর গুহের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় প্রথম কবিতা। তারপর দে ছুট। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেয়েছেন আদমজী পুরস্কার (১৯৬৩), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), একুশে পদক (১৯৭৭), সাংবাদিকতার জন্যে পেয়েছেন জাপানের মিৎসুবিশি পদক (১৯৯২), ভারতের আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) ছাড়াও বহু পুরস্কার। ডিলিট উপাধিতেও ভূষিত হয়েছেন। ‘মর্নিং নিউজ’-এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে ১৯৫৭ সালে যে চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন, একই পেশায় থেকে ১৯৮৭ সালে দৈনিক বাংলার সম্পাদক পদ থেকে তিনি চাকরিতে ইস্তফা দিয়েছেন, তবু খেই হারাননি জীবন, সাহিত্য ও কবিতার পাঠ থেকে। মূলত কবি হলেও সাহিত্যে তাঁর কাজ বহুমাত্রিক। অনুবাদ সাহিত্য থেকে গদ্যের বিভিন্ন প্রশাখায় বিচরণ করেছেন তিনি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট ৭৬ বছর বয়সে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।