মধ্য-উনিশ শতক থেকে শুরু করে বিশ শতকের প্রথম সিকি পর্যন্ত ভারতবর্ষে সংঘটিত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যে সিপাহী-বিপ্লব (১৮৫৭) এবং বঙ্গভঙ্গ (১৯০৫) ও বঙ্গভঙ্গ-রদ (১৯১১) অন্যতম। এ সময়ের আন্দোলনের দুটো রূপ মোটাদাগে পরিলক্ষিত হয়। এক. অহিংস রূপ; যেমন: অনশন ধর্মঘট, অসহযোগ, স্বদেশি আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়। দুই, সহিংস রূপ; যেমন খুদিরাম, সূর্যসেন, তিতুমির, ভগৎসিং মঙ্গলপাণ্ডেসহ বিভিন্ন বিপ্লবীর আন্দোলন প্রক্রিয়া। স্বদেশ ও জাতীয়তাবোধকে বুকে ধারণ করেই এসমস্ত আন্দোলন বেগ ও বিস্তৃতি লাভ করেছে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন জ্ঞানতাপস এবং ঋষিস্বভাবের মানুষ। অহিংসা, শান্তি, নির্মলতা, মানবতার শিক্ষা রবীন্দ্রনাথ তাঁর বাবার কাছ থেকেই লাভ করেছেন। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে বাবার মৃত্যু রবীন্দ্রনাথের ভাবনার জগৎকে ব্যাপকভাবে নাড়িয়ে দেয়। ১৯০৮-এ খুদিরামের ইংরেজ-নিধন, ১৯৩০-এ সূর্যসেনের দলের ব্রিটিশ অস্ত্রাগার লুট, স্বদেশি আন্দোলনে জাতীয়তাবাদের নামে সহিংসতা প্রদর্শন রবীন্দ্রনাথ ঠিক পছন্দ করেননি। তাই, স্বদেশি আন্দোলনে সক্রিয় থাকলেও এক পর্যায়ে এর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেন তিনি। এ কারণে তাঁকে 'ব্রিটিশের নিজস্ব লোক'ও মনে করতে থাকেন কেউ কেউ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।