বিভিন্ন দেশের সাহিত্যে সবসময়ই সমাজচিত্র চিত্রিত হয়, এটা সাহিত্য নির্মাণের একটি বিশেষ দায়। বলা বাহুল্য চিত্রন স্বার্থকতা পায় একটি সাহিত্য শিল্পের আদলে বাস্তবতাকে কতোটুকু বস্তুনিষ্ঠভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছে তার উপর। সাহিত্যের একেকটা নির্মাণ একেকটা ভাব। যে ভাব নির্মাণ করে সে ভাবুক। উলেখ্য, নির্মিত এই ভাবের উৎস কিন্তু বস্তু। বস্তু প্রত্যক্ষণের পরিণামেই উদ্ভব ঘটে ভাবের। এই গল্পের কাহিনী লেখকের বস্তুপ্রত্যক্ষণেরই পরিণাম। এক্ষেত্রে লেখক স্বাধীনÑতিনি কীভাবে সেই সমাজচিত্রকে উপস্থাপন করবেন। উলেখ জরুরীÑরাষ্ট্রের তুলনায় সমাজের চৌহদ্দী ব্যাপক; কিন্তু সমসাময়িক জীবনবাস্তবতায় সমাজ অপেক্ষা রাষ্ট্র অধিক বাস্তব। পূর্বের সমাজভিত্তিক জীবনব্যবস্থাটা আসলে আর নেই। এ লক্ষ্যে একটি বিষয় বলা জরুরী এবং এটা একটি সাধারণ পর্যবেক্ষণ, যে বিষয়টি দ্বারা বর্তমান সময়ের মানুষ তার সারাটাকাল প্রভাবিত থাকে সেই বিষয়টি নিয়ে তারা ভাবিত হয় না। এটি গল্পে স্থান পেয়েছে গল্পের চরিত্র নীরুর একটি বক্তব্যে, যেখানে নীরু বলে, সমষ্ঠি এমনি। সেই অনুক্ত বিষয়টি হলো ‘রাষ্ট্র’ যেটাকে এই গল্পে লেখক বলেছেন ‘সমিতি’ সত্য হলোÑআদতে এটি সমিতি-ই। ‘কথাদাও’ গল্পে লেখক এই সমিতির উদ্ভব ও তার পরিচলনের রূপরেখার ছায়াটি চরিত্রের আলোচনায় এনেছেন। ব্যক্তির মনোজগৎ পর্যালোচনা এবং তার পরিমাপে একটি গণ-মনোজগতের উপস্থিতি ধরা পড়ে অর্থাৎ অধিকাংশ মানুষের মনোজগৎটি সাধারণ। আয় রোজগার সংসার প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি ঘরানায় নিবিষ্ট থাকে অধিকাংশের জীবন। এই গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র নীরুর মনোজগৎটি সেইরূপ নয়। সে চলমান কাঠামো যেমন শাসন, শিক্ষা, পরিবারব্যবস্থা ইত্যাদিতে অযুক্তি দেখতে পায় এবং মানুষের মাঝে বিরাজমান স্তরব্যবস্থাটিকে ছলনা মনে করে। যেমন, সে তার মায়ের কাছে জানতে চায়, মা বলতো মানুষ কিরূপ প্রাণী ? শিশুর প্রাথমিক সামাজিকীকরণ প্রক্রিয়াটি তার সারাজীবনে নানাভাবে প্রভাব ফেলে। নীরুর বেলায়ও তার ব্যত্যয় ঘটেনি ক্লাইমেক্স দিয়ে তার জীবন শুরু, ক্লাইমেক্স দিয়ে শেষ। এইসব ক্লাইমেক্সের পরতে পরতে প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য বাস্তব সত্য। এটা কি সত্য নয় আমাদের এই দেশের জন্মকালে যারা সীমাহীন বাধারপ্রাচীর নির্মাণ করেছিল জন্মকালের নিকট পরেই তাদের হাতে এদেশের স্বপ্নের পতাকা ওঠেছিল ? নীরু সমষ্টির মাঝে বোধ জাগাতে চেয়েছেÑমানবসভ্যতার রকমপ্রকরণের। লেখক নিজে তার সৃষ্ট চরিত্র থেকে একধাপ এগিয়ে ঘোষণা দেয়, নীরুর এই চিন্তা ও উদ্যোগটি আসলে মূলচিন্তার উপজাত। মূল চিন্তাটা হলো পির্তৃহত্যার প্রতিশোধ। অর্থাৎ লেখক অতিআদর্শের মার্কামেরে চরিত্রকে দেশপ্রেমিক বানাতে চাননি। তিনি সত্য উৎঘটান করতে চেয়েছেন ব্যক্তির মৌলস্বরূপ উন্মোচন করেÑএই ব্যাপারটি এই গল্পের একটি বিশিষ্টতা। নীরুর জন্য খুব মায়া হয়। মনের গহীন কোণে মায়ের প্রতি মায়ার জগৎ তৈরি হয় তার। সেই মায়া বাস্তবতা পায় না। তার মন হাহাকার করে ওঠে। সে মায়ের কাছে যেতে চায়। মায়ের কাছে প্রতিশ্র“তি চায় তার কাছে গিয়ে বাস করার।