তখনও ‘নারীবাদ’ বা ‘ পুরুষতন্ত্র’ শব্দগুলো কানে আসেনি। কিন্তু পরিবারে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক-অবমাননাকর আচরণাদি দেখে দেখে শৈশবেই মনের গহীনে জারিত হয়েছিল পুরুষ শ্রেণীর প্রতি ঘৃণা ও বিদ্রোহের। মনে মনে ভাবতাম―পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে রোপিত নারীর প্রতি বৈষম্যের বীজ উৎপাটনের উপায় কি! শৈশবের একাকিত্ব আমাকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তোলে। ঘরে-বাইরে, আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে যেখানেই যেতাম না কেন― আমি, ডুবে যেতাম বইয়ের মধ্যে। পঞ্চম শ্রেণীতে ওঠার পর বিভ‚তিভ‚ষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাচালী’ গোগ্রাসে পড়ে ফেললাম। এই গ্রন্থ পাঠের মধ্য দিয়ে আমার মধ্যে জন্ম নিল নতুন পাঠক সত্তার। ষষ্ঠ শ্রেণীতে আসক্ত হলাম ক্লাসিক উপন্যাস পাঠের প্রতি। বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের রচনাবলী আমাদের ঘরেই ছিল। বাকি মনীষী লেখকদের বই জোগাড় করে নিতাম। আমার মাও ছিলেন বইপোকা এক পাঠক। তাই নতুন লেখকদের বই, পত্র-পত্রিকা নিয়মিত কেনা হতো। একাত্তরের আগুন ঝরা দিন শেষে পেলাম স্বাধীন বাংলাদেশ। ১৬ ডিসেম্বর মনে হলো স্বাধীনতা যুদ্ধে বিজয়ের মধ্য দিয়ে নবজন্ম হলো আমার নিজেরও। স্বাধীন দেশের নতুন চিন্তা-চেতনা, ধ্যান-ধারণার অšে¦ষণে উন্মুখ আমাদের অনাঘ্রাত তরুণ মন। সুরাইয়া বেগম, আবুল হাসান, রফিক আজাদ, হেলাল হাফিজ, আল মাহমুদ প্রমুখের কবিতার মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকি। কাহলিল জিবরানের ‘দ্য প্রফেট’ পড়ে তোলপাড় হই। এরই মধ্যে কোনো এক পয়লা বৈশাখে বাংলা একাডেমির চত্বরে বসল ক্ষুদ্রাকৃতির ‘বইমেলা’। সেখান থেকে কিনলাম মাওলা ব্রাদার্স প্রকাশিত মাহবুব তালুকদার রচিত ‘জন্মের দক্ষিণা’ নামের কবিতার বইটি। সেই বইতে ‘মেয়েটি’ নামে ছোট্ট একটি কবিতা পড়ে চমকে গেলাম। মনে হলো, কবিরা কি ঈশ্বর? নইলে একজন পুরুষ হয়ে কবি কিভাবে জানলেন নারী জনমের কঠিন যন্ত্রণাবোধ? চুয়াত্তর কিংবা পঁচাত্তরে হাতে এলো কলকাতার প্রথিতযশা কবি কবিতা সিংহের কবিতা সংকলন। সেই গ্রন্থে সংযুক্ত ‘ঈশ্বরকে ইভ’ কবিতাটি আমার দৃষ্টিদান করল ‘নারীবাদী’ চেতনার। নবচৈতন্যের খনন প্রক্রিয়ারই অংশস্বরূপ ‘নারীবাদী’ কবিতা সংকলন ‘কিরণমালা’ প্রকাশনা।