রাত থেকে দিন আলাদা হয়ে যাবার সময়- সুবেহ সাদেকের পলকা আলো লেপটে আছে বাতাসের গায়ে। রাতের ফেরেশতারা বিদায় নিয়েছে, আসমান থেকে পৃথিবীতে নেমে এসেছে দিনের ফেরেশতারা। জুলাইয়ের এমনি এক সকালে আনাস এসেছিল মাদায়েন সালেহ্ শহরে। চারিদেকের নিস্তব্ধতা আর পাহাড়ি উপত্যাকায় আলো- অন্ধকারের রণাঙ্গনে দাঁড়িয়ে আনাস অনুভব করে সামুদদের নিষ্ঠুরতা। পাহাড়ের দূর্গে বন্দি হওয়া বাতাসের শব্দ যেন- কোন এক সুন্দরী কুমারী সামুদ কিশোরির বিষাদগীতি। আবার যেন তাও নয়! এ যেন সামুদ যৌনদাসীর অভিশপ্ত আত্মার প্রলব! সামুদদের খোদাই করা পাহাড়ের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে ভোরের আলোয় ডানা মেলে ধরেছে- হুদহুদ পাখি। যে পাখি নবী সুলায়মানকে বলে দিয়েছিল ইয়েমেনের চক্রান্তকারী রানী বিলকিসের খবর। খাদ্যের সন্ধানে ঝাক বেঁধে ছুঁটে চলেছে- আবাবিল। সহসা বিগত মহাকাল থেকে আনাসকে জাপটে ধরে এক যাদুর সময়। আনাস শুনতে পায় সামুদদের তীর, ধুনক আর যুদ্ধ দামামার ধ্বনি। নাকে ভেসে আসে রুক্ষ রক্তের গন্ধ। হঠাৎ পাহাড়ের গা বেয়ে জমিনে নেমে আসে এক দরবেশ। তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে একটি উট। দরবেশের দৃষ্টিতে আছে দৈব আলো। চোখে তাকিয়ে মনের কথা পড়ে নিতে পারে। আনাসের চোখে তাকিয়ে পবিত্র হাসি হেসে তিনি বলেন- তুমি বড় ক্লান্ত পুত্র। তারপর উটের পিঠে রাখা গেরবা ( পানি রাখার চামড়ার থলে) থেকে আনাসকে পানি খেতে দিয়ে আবার বললেন- তৃষ্ণা মেটাও, চক্ষু শীতল করো। তারপর অভিশপ্ত সামুদদের ধ্বংসের ঘটনা শোনাতে শোনাতে হঠাৎ যেন বাতাসের সাথে মিলিয়ে যান দরবেশ। বেলা বাড়তে থাকে, রানিমের সাথে দেখা হয় আনাসের। কিন্তু কথা হয় না ওদের। রানিম চলে যায় ওর ভাইয়ের হাত ধরে। কিছুক্ষণ পরে রানিম আবার আসে একা, তখন ওরা সামুদ প্রাসাদের ভিতরে প্রবেশ করে। হয়ত আজই ওদের শেষ দেখা। মুদিত আঁখি, ভেজা কণ্ঠ আর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওরা স্মরণ করে- ফেলে আসা দিনগুলোর কথা। যেন নতুন করে শব্দ বোনার প্রয়োজন শেষ হয়েছে। সামুদদের কাপড় রাখা র্যাকের গায়ে জমে থাকা সহস্র বছরের লাল ধুলোয় আনমনে হাত বোলাতে থাকে রানিম। তখন আক্ষেপ জড়ানো কণ্ঠে আনাস বলে ওঠে- তোমার ওই পবিত্র হাতের ছোঁয়ায় হয়ত পূর্ণ হলো কোন অভিশপ্ত সামুদের আত্মা, অথচ আমি রয়ে গেলাম অপূর্ণ। কখনো ছুঁয়ে দেখা হয় নি তোমার পবিত্র ওই হাত!
নিগূঢ় বোধ সমৃদ্ধ কথাসাহিত্যিক কাজী সাইফুল ইসলামের শিল্প চর্চার পরিমণ্ডলে গল্প, উপন্যাস, কবিতাই প্রধান উপজীব্য হয়ে ধরা দিয়েছে। কেবল এ তিন শাখাতেই বিচরণ করে স্থবির হন নি তাঁর সাহিত্য পিয়াসি মন- মনের আবেদন পূরণে প্রবন্ধ এবং গবেষণাধর্মী কাজে নিমজ্জিত হয়েছেন তিনি আর চলমান বাংলা সাহিত্যে রেখেছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ এবং দেশ ভাগের সময়কাল সহ দেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বেশ নিখাদ ভাবেই চিত্রায়িত হয়েছে তাঁর উপন্যাসে। লেখনীর ভেতরে গল্পের চাদর মুড়িয়ে বাঙালী জাতির ইতিহাস বিধৃত করার যে শৈল্পিকতা তিনি উন্মোচিত করেছেন, তা চিরায়ত ধারা থেকে বেশ খানিকটা আলাদা বলেই বিবেচিত। কাজী সাইফুল ইসলাম বিশ্বাস করেন- "সাহিত্য কেবলমাত্র বিনোদনের উৎসই নয়- সাহিত্য এমন এক মহামানব যার আলোয় ক্রমাগত বিকশিত হচ্ছে জীবন ও সভ্যতা।"