সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ গল্প, উপন্যাস, নাটক-এই তিন শাখাতেই তিনি লেখনী ধারণ করেছেন। দুটি গল্পগ্রন্থ, তিনটি উপন্যাস আর তিনটি নাটক। তাঁর অল্প আয়ুষ্কালে প্রকাশিত হয়েছিল মাত্র এই আটটি গ্রন্থ। পরে আরো কিছু রচনার মধ্যে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর আত্মব্যক্তিত্ব এমনভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছে যে কথাসাহিত্যের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হয়ে গেছে। মনে রাখতে হবে, ওয়ালীউল্লাহ অনগ্রসর সমাজের জন্য স্বপ্ন রেখে যেতে চেয়েছিলেন, আর ইংরেজি শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া মুসলমানদের কথা ভেবেই তাঁর সাহিত্যচর্চা শুরু। ওয়ালীউল্লাহ যখন মাজার সৃষ্টিকারী মজিদের কাহিনি বীক্ষণে তুলে আনেন, তখন স্পষ্ট উপলব্ধি হয় নিউ স্কিম মাদ্রাসা শিক্ষা প্রবর্তনের পূর্বেকার ইংরেজি স্পর্শ বঞ্চিত এই ধর্মজীবী অস্তিত্বের সংকট চিত্রণই তাঁর উদ্দেশ্য। 'চাঁদের অমাবস্যায়' দেখা যায়, অপরাধ ক্রিয়ার সাক্ষী আরেফ আলী স্বীয় কর্তব্য নির্ধারণ করে আইনের দ্বারে যায়, অপরাধ সম্পর্কে জ্ঞাত ব্যক্তির কর্তব্য করে। 'কাঁদো নদী কাঁদো' উপন্যাসে দেখা যায় মুস্তফার পিতার কূট বুদ্ধি, বাক্চাতুর্থ, ষড়যন্ত্র জ্ঞান সবই ছিল, কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় ছিল উনতা, যে জন্য তিনি ভাড়াটে সাক্ষী হয়েই জীবন অতিবাহিত করেন ও এই সাক্ষ্যরই জের হিসেবে আততায়ীর হাতে নিহত হন। খেদমত উল্লাহ অপরাধ সম্পর্কে মিথ্যা সাফাই গাইতেন। শঠতার বিবেচনায় তিনি মজিদের উত্তরসূরি।
Syed Waliullah (তাঁর জন্ম চট্টগ্রাম শহরের ষোলশহর এলাকায়, ১৯২২ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ আগস্ট) তাঁর পিতা সৈয়দ আহমাদুল্লাহ ছিলেন একজন সরকারি কর্মকর্তা; মা নাসিম আরা খাতুনও সমতুল্য উচ্চশিক্ষিত ও রুচিশীল পরিবার থেকে এসেছিলেন, সম্ভবত অধিক বনেদি বংশের নারী ছিলেন তিনি। ওয়ালীউল্লাহর আট বছর বয়সের সময় তার মাতৃবিয়োগ ঘটে। দুই বছর পর তার বাবা দ্বিতীয়বার বিয়ে করেন টাঙ্গাইলের করটিয়ায়। বিমাতা এবং বৈমাত্রেয় দুই ভাই ও তিন বোনের সঙ্গে ওয়ালীউল্লাহর সম্পর্ক কখনোই অবনতি হয় নি। তার তেইশ বছর বয়সকালে কোলকাতায় চিকিৎসা করতে গিয়ে মারা যান। তার পিতৃমাতৃবংশ অনেক শিক্ষিত ছিলেন। বাবা এম এ পাশ করে সরাসরি ডেপুটি মেজিস্ট্রেট চাকুরিতে ঢুকে যান; মাতামহ ছিলেন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স থেকে পাশ করা আইনের স্নাতক; বড়ো মামা এমএবিএল পাশ করে কর্মজীবনে কৃতি হয়ে খানবাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন এবং স্ত্রী ওয়ালীউল্লাহর বড়ো মামী ছিলেন নওয়াব আবদুল লতিফ পরিবারের মেয়ে, উর্দু ভাষার লেখিকা ও রবীন্দ্রনাথের গল্প নাটকের উর্দু অনুবাদক। ১৯৩৯ সালে তিনি কুড়িগ্রাম উচ্চ বিদ্যালয় হতে ম্যাট্রিক, এবং ১৯৪১ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন। তার আনুষ্ঠানিক ডিগ্রি ছিলো ডিস্টিঙ্কশনসহ বিএ এবং অর্থনীতি নিয়ে এমএ ক্লাশে ভর্তি হয়েও শেষে পরিত্যাগ করেন। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ওয়ালীউল্লাহ ঢাকায় এসে প্রথমে ঢাকা বেতার কেন্দ্রের সহকারী বার্তা-সম্পাদক ও পরে করাচি কেন্দ্রের বার্তা-সম্পাদক (১৯৫০-৫১) হন। ১৯৫১-৬০ সাল পর্যন্ত তিনি পাকিস্তান সরকারের পক্ষে নয়াদিল্লি, সিডনি, জাকার্তা ও লন্ডনে বিভিন্ন উচ্চ পদে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬০-১৯৬৭ সাল পর্যন্ত তিনি প্যারিসে পাকিস্তান দূতাবাসের ফার্স্ট সেক্রেটারি এবং ১৯৬৭-৭১ সাল পর্যন্ত ইউনেস্কোর প্রোগ্রাম স্পেশালিস্ট ছিলেন। সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ দুটি গল্পগ্রন্থ নয়নচারা (১৯৫১), দুই তীর ও অন্যান্য গল্প এবং তিনটি নাটক বহিপীর (১৯৬০), তরঙ্গভঙ্গ (১৯৬৪) ও সুড়ঙ্গ (১৯৬৪) রচনা করেছেন। ছোটগল্প ও নাটকেও তিনি সমাজের কুসংস্কার, ধর্মীয় ভন্ডামি, মানসিক ও চারিত্রিক স্খলন ইত্যাদিকে প্রতিভাসিত করেছেন। তিনি দেশ-বিদেশের নানা সাহিত্য পুরস্কার এবং বাংলাদেশ সরকারের ‘একুশে পদক’ (মরণোত্তর, ১৯৮৩) লাভ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ অক্টোবর প্যারিসে তাঁর মৃত্যু হয় এবং প্যারিসের উপকণ্ঠে মদোঁ-স্যুর বেল্ভু-তে তিনি সমাহিত হন।