সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ শিক্ষক ছিলেন। ছিলেন শিক্ষা-সংগঠকও। শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করে যেমন শিক্ষার প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেছেন, তেমনি সেই বিদ্যাপীঠে বক্তৃতা প্রদান করে হয়েছেন অনুকরণীয় বিদ্যোৎসাহী। শিক্ষা-বিষয়ক নিবন্ধ রচনা করেও তিনি সমকালে ও উত্তরকালে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। স্বদেশ-সমাজ নিয়ে ভাবনার নানাবিধ। প্রবণতায় রবীন্দ্রনাথের শিক্ষাভাবনা আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে বহুকাল। “শিক্ষা’ নামক গ্রন্থে তিনি তৎকালীন ভারতবর্ষের, বিশেষ করে, বাঙালির অনুসৃত শিক্ষা-কাঠামো, শিক্ষক ও শিক্ষার্থী, শিক্ষা-পরিস্থিতি এবং শিক্ষা-ব্যবস্থাপনা সম্বন্ধে অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ মতামত প্রকাশ করেছেন। শুধু সংকটের কথাই উপস্থাপন করেননি, সমস্যা থেকে উত্তরণের বিচিত্র পথেরও সন্ধান দিয়েছেন। অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ আমাদের দেশের প্রচলিত শিক্ষা-ব্যবস্থার প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং কাক্ষিত উন্নয়নের জন্য পথ বাতলিয়েছেন। লেখাপড়ার মাধ্যম যে মাতৃভাষাই হওয়া উচিত- এ বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ জোরালো অভিমত ব্যক্ত করেছেন। পাশাপাশি ভিনদেশি শিক্ষাদর্শন-বিজ্ঞানভাবনা-ন্যায়চিন্তা এবং সংস্কারমুক্তি যে প্রতিটি নাগরিকের জন্য কত প্রয়োজন, তা বুঝিয়ে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ । বিশেষ করে ইউরোপের শিক্ষা-সমস্যা ও শিক্ষা-আন্দোলনের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বাংলাদেশের শিক্ষা-সংক্রান্ত, সুবিধা-অসুবিধার একটা তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে চেয়েছেন। আর দেশীয় বাস্তবতায় তার সমাধানের দিকও বাতলে দিয়েছেন। শিক্ষালাভের মধ্য দিয়ে মানুষ আত্মরক্ষার যে প্রচেষ্টা আয়ত্ত করে এবং শেষত যে জাতীয় ও ব্যক্তিক আত্মসম্মান অর্জন করে, তাতেই শিক্ষা-ব্যবস্থাপনার মূল মনোযোগ স্থির থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেছেন। তাঁর মতে, 'সুশিক্ষার লক্ষ্য এই যে, তাহা মানুষকে অভিভূত করে না, তাহা মানুষকে মুক্তিদান করে ।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।