জীবনের পরিপূর্ণ প্রকাশ গল্পে উপস্থাপিত না হলেও, জীবনের যে খণ্ডাংশ গল্পে ওঠে আসে তা গভীর বােধকে নাড়া দিতে সক্ষম। বােধের এ গভীরতায় নাড়া দিতে সক্ষম শাহাদুজ্জামানের (জ.১৯৬০) গল্পগুলাে। সমকালীন গল্পকারদের মধ্যে শাহাদুজ্জামানের গল্পে বিশেষ বাঁক লক্ষ করা যায় এবং যা পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম। মানব জীবনের গভীর বােধ বিশ্লেষণ তাঁর গল্পে সহজ-সাবলীলভাবে ওঠে এসেছে। তাঁর গল্পে যে মানুষের ছবি ওঠে এসেছে, সেই মানুষ আমাদের অভিজ্ঞতারই প্রতিফলিত মানুষ। কিন্তু আমাদের দেখা সেই মানুষ যখন গল্পকারের বর্ণনাতে নতুন ভাবে ধরা দিয়েছে, তখন পাঠকের জন্য নতুন করে ভাবনার সুযােগ সৃষ্টি হয়েছে, যে ভাবনা পাঠককে বিহ্বল করতে সক্ষম, জীবনবােধের মুখােমুখি করতে সক্ষম। শাহাদুজ্জামানের গল্পে ব্যক্তি ও ব্যক্তির অন্তর্দ্বন্দ্ব, ব্যক্তি ও ব্যক্তির কর্মক্ষেত্র ওঠে এসেছে পরিবেশ ও প্রতিবেশকে আলিঙ্গন করেই। সমকাল ও রাজনীতি, দৈশিক ও বৈশ্বিক প্রভাব-পরিস্থিতি তাঁর গল্পের বিষয়ের বিস্তৃতি ও বৈচিত্র্যকে তুলে ধরেছে। বিষয়ের এ বৈচিত্র্য এবং জীবনঘনিষ্ঠ প্রকাশ আমাকে তাঁর গল্পের প্রতি বিশেষভাবে আকর্ষিত করে তুলে। সে কারণে আমি শাহাদুজ্জামানের গল্প: বিষয়-বৈচিত্র্য' শীর্ষক অভিসন্দর্ভটি রচনায় উৎসাহী হই। নিজের সীমাবদ্ধতা ও ব্যক্তিক দায় সত্ত্বেও বইটি গুরুজন কবি শিমুল মাহমুদ, রাহেল রাজিব ও শফিক আশরাফ স্যারকে উৎসর্গ করতে পেরে আনন্দিত বােধ করছি। অভিসন্দর্ভটি রচনাকালে আমাকে অনুপ্রাণিত ও আগ্রহী করেছেন আমার গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ড. পরিমল চন্দ্র বর্মণ এবং বই সরবরাহ করে সহায়তা করেছেন নােয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের বিভাগীয় প্রধান চন্দন আনােয়ার, এছাড়াও বন্ধু অয়নিকা আলপনা ও বিভাগের অন্যান্য শিক্ষকদের সহায়তা ও আন্তরিকতা আমার এ কাজকে আরাে সহজ করেছে।
সমসাময়িক বাংলা কথাসাহিত্যে মননশীল সাহিত্যিক হিসেবে শাহাদুজ্জামানের অবস্থান অনন্য ও অগ্রণী। গল্প, উপন্যাসেই বেশি পরিচিত হলেও শাহাদুজ্জামানের উল্লেখযোগ্য কাজ রয়েছে প্রবন্ধ, অনুবাদ, ভ্রমণ এবং গবেষণার ক্ষেত্রেও। লেখকের মতে, তিনি আল বেরুনীর মতো দীর্ঘ নয়, বরং বিস্তৃত জীবনের আকাঙ্ক্ষা করেন। ১৯৬০ সালে ঢাকায় জন্মগ্রহণ করেন কথাশিল্পী শাহাদুজ্জামান। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করেন মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজ থেকে। এরপর চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করে চিকিৎসক হিসেবে কাজ করেছেন উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের গ্রামীণ স্বাস্থ্য প্রকল্পে। উচ্চতর শিক্ষার জন্য পরবর্তীতে জনস্বাস্থ্য বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং নেদারল্যান্ডসের আমস্টার্ডাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিকিৎসা নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। কর্মজীবনে শাহাদুজ্জামান দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ বিভাগে। বর্তমানে তিনি যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ও গবেষণা কাজের সাথে যুক্ত রয়েছেন। পারিবারিকভাবে সাহিত্যের যে ঘোর শৈশবেই আচ্ছন্ন করেছিলো তা-ই শাহাদুজ্জামানের সাহিত্যিক হয়ে ওঠার পাথেয় হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৯৬ সালে মাওলা ব্রাদার্স আয়োজিত কথাসাহিত্যের পান্ডুলিপি প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়ে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম ও ছোটগল্পগ্রন্থ ‘কয়েকটি বিহ্বল পাখি’। শাহাদুজ্জামান এর বই সমূহ ঠিক প্রচলিত উপন্যাসের গৎবাঁধা আঙ্গিকে ধরা যায় না। অনেক সাহিত্যবোদ্ধা তাই তাঁর লেখাকে ফিকশন-নন ফিকশন, পদ্য-কথাসাহিত্য, সবকিছুর মিশেলে ‘ডকু ফিকশান’, আবার অনেকে ‘মেটাফিকশান’ বলে রায় দিয়ে থাকেন। শাহাদুজ্জামান এর বই সমগ্র এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্রাচের কর্নেল, আধো ঘুমে ক্যাস্ট্রোর সঙ্গে, একটি হাসপাতাল একজন নৃবিজ্ঞানী কয়েকটি ভাঙ্গা হাড়, ক্যাঙ্গারু দেখার শ্রেষ্ঠ দিন এবং অন্যান্য অনুবাদ গল্প, কয়েকটি বিহ্বল গল্প, মামলার সাক্ষী ময়নাপাখি, কাগজের নৌকায় আগুনের নদী, এবং কবি জীবনানন্দ দাশের উপরে লেখা উপন্যাস ‘একজন কমলালেবু’। কমলা রকেটসহ বেশ কিছু চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যও রচনা করেছেন শাহাদুজ্জামান। ২০১৬ সালে বাংলা কথাসাহিত্যে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার।