সৃজনশীল প্রতিভা উজ্জীবিত হয় স্থানকালের সন্নিপাতে। চেতনা যেহেতু বস্তুরই উন্নত ও সম্প্রসারণশীল রূপ, তাই তা জড়িয়ে থাকে বস্তুজগতের চতুর্মাত্রায়। সেই মাত্রায় নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত থাকে সময়। বস্তুজগৎ, মানুষ ও তার কর্মপ্রবাহ-মনস্তত্ত্ব-বাসনা সেই সম্পৃক্তায়নের মৌল প্রাণতা। রবীন্দ্রনাথ সৃজনাবেগে চঞ্চল, ক্রিয়ামুখর ও জীবনঘন হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের পতিসর-শাহজাদপুর-শিলাইদহে এসে। তাঁর জনজীবনাভিজ্ঞতা, ভূপ্রকৃতি আর কৃষি সাংস্কৃতিক প্রাণপ্রবাহটি উচ্ছলিত হয়েছিল এই বঙ্গে বসবাসের সূত্রে এবং তাঁর চেতনা থেকে ঘুচে গিয়েছিল কলকাতার বাবু-কালচারের ক্ষয়-ক্ষতি, ঔপনিবেশিক সংস্কৃতি-শিক্ষার সংকট ও জটিলতা। বাংলাদেশে রবীন্দ্রনাথের আগমন ও দশকব্যাপী বসবাস একদিকে তাঁকে করেছে সৃষ্টিমুখর, উৎসার ঘটিয়েছে প্রকৃতির গহনে-সৌন্দর্যে অবগাহনের ফল্গুধারার। তিনি বিশ্বজাগতিকতাকেও এখানে এসেই নিজ অনুভবে-বোধে জারিত করতে পেরেছিলেন। রবীন্দ্রসৃজনে বাংলাদেশ এই নাতিপরিসর গ্রন্থটির রচয়িতা তরুণ লেখক রাফাত মিশুর আবেগঘন বিশ্লেষণধর্মী একটি কাজ। তিনি ছিন্নপত্র, সোনার তরী-চিত্রা-চৈতালি কাব্যত্রয় এবং ‘রবীন্দ্রগল্পে বাংলাদেশের চার প্রকৃতিকন্যা’ নিয়ে অনুপুঙ্খ ব্যাখ্যায় উন্মোচন করতে চেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের শিল্পদর্শন, জীবনবোধ, নারী-মনস্তত্ত্ব এবং এসবের পরিপ্রেক্ষিতরূপে তৎকালীন বাংলাদেশের ভূপ্রাকৃতিক রূপবর্ণিল প্রাণশক্তিকে। রবীন্দ্রনাথ যে নিছক প্রকৃতিমুগ্ধতায় অবসিত না হয়ে তার মধ্যে কর্মপ্রবাহ ও নারীমনকে আবিষ্কার করতে পেরেছেন, তা গ্রন্থকার উন্মোচন করতে সমর্থ হয়েছেন। ‘গীতাঞ্জলির বিরহদর্শন’-এর মতো দার্শনিক-সাঙ্গিতিক জটিল বিষয়ও এখানে সন্নিবেশিত। তদুপরি লেখক অন্নদাশঙ্কর রায়ের আর্ট ভাবনার ব্যাখ্যায় ক্ষীণভাবে হলেও রবীন্দ্রশিল্পভাবনার সূত্র গেঁথেছেন। গ্রন্থটি প্রাঞ্জল ও তথ্য-উপাত্তে সমৃদ্ধ। এই তরুণ লেখকের রবীন্দ্রবীক্ষার প্রারম্ভবিন্দুরূপে রবীন্দ্রসৃজনে বাংলাদেশ গ্রন্থটি সমাদৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস। —অধ্যাপক ড. বেগম আকতার কামাল বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
জন্ম ১৯৮৯ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন। প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা: জামালপুর জিলা স্কুল, নটর ডেম কলেজ ঢাকা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ। আগ্রহের বিষয়: বাংলাদেশ-পাঠ; সাহিত্যের নব্যইতিহাসবাদী পাঠ; সাহিত্যে আর্থরাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতার অনুসন্ধান। প্রকাশিত কবিতার বই: ‘শরীরী অশরীরী ’(ভাষাপ্রকাশ, ২০১৪), ‘অসময়ের ঘ্রাণ’ (বাংলানামা, ২০১৯)। প্রবন্ধের বই: ‘রবীন্দ্রসৃজনে বাংলাদেশ’ (আদর্শ, ২০২০)। গ্রন্থনা-সংকলন ও সম্পাদনা: ‘শতবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ : উচ্চতর গবেষণার রূপরেখা’ (মাওলা ব্রাদার্স, ২০২১)। গবেষণামূলক প্রবন্ধ লেখার জন্য পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কলা অনুষদ ডিনস্ অ্যাওয়ার্ড ২০২২’।