প্রাক কথন অনেক বছর আগের থেকেই বাংলা সাহিত্যের পাঠক-পাঠিকারা হাইকু শব্দটির সঙ্গে পরিচিত। রবীন্দ্রনাথ হাইকুর সঙ্গে বাংলা ভাষার পাঠকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থের মাধ্যমে। ‘জাপানযাত্রী’ গ্রন্থে হাইকুর সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়ে তিনি মন্তব্য করেছেন, তিন লাইনের কবিতাকে হাইকু বলে। পৃথিবীতে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম কবিতা এই হাইকু। তিন লাইনের কাব্য, এই জগতে আর কোথাও নাই। হাইকু হলো জাপানি বড় কবিতার ক্ষুদ্রতম রূপ। পনের শতকের মাঝের দিকে ‘ওয়াকা’ বা ‘জাপানি পদ্য’তে একটি নতুন ধারায় কবিতা লেখা শুরু হয়, যে ধারার নাম ছিল ‘হাইকাই’। জাপানি ‘হাইকাই’ শব্দটির অর্থ হলো মজা, কৌতুক, নীচুতা, পার্থিব ইত্যাদি। এই ধরনের পদ্যগুলোতে কৌতুকের পরিমাণ ছিল বেশি। সবচেয়ে পুরানো ‘হাইকাই’ দেখতে পাওয়া যায় ৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত ‘কোকিন শু’ নামক একটি ওয়াকা সংকলনের মধ্যে। হাইকু তিনটি সংক্ষিপ্ত লাইনে ১৭টি সিলেবল নিয়ে এর গঠন। প্রথম লাইনে পাঁচটি, দ্বিতীয় লাইনে সাতটি আর শেষের লাইনে পাঁচটি সিলেবল দিয়ে তৈরি হয় হাইকু অনুকাব্য। আদিতে হাইকুর নাম ছিল ‘হক্কু’, যার অর্থ ছিল ‘রেঙ্গা’ নামক পরস্পর সংযুক্ত লাইনসংবলিত কবিতার প্রথম ভাগ। ‘রেঙ্গা’ ছিল অনেক বছর আগের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা, যার উৎপত্তি হয় ৩১ সিলেবলের ‘ওয়াকা’ কবিতাকে ৩৭ এবং ১৪ সিলেবলে বিভক্ত করে। হাইকু লেখার সনাতন পদ্ধতি অনুযায়ী প্রতি হাইকুতেই ঋতুর প্রতি সরাসরি বা পরোক্ষভাবে সম্পর্কের আভাস বা ইঙ্গিতের ব্যবহার থাকা বাঞ্ছনীয়। বিখ্যাত হাইকুর লেখককে হাইকুর প্রাণপুরুষও বলা হয়ে থাকে, প্রতি হাইকু কবিতাতেই প্রকৃতির স্পর্শ থাকতে হবে। যেহেতু প্রকৃতি ঋতুনির্ভর সেজন্য হাইকুর ভেতর ঋতুর প্রতিনিধিত্ব থাকা প্রয়োজন। এমনকি যখন ব্যক্তিগত আবেগকে কেন্দ্র করে হাইকু লেখা হয়, সেখানেও ঋতুর ইঙ্গিত প্রত্যাশা করা হয় এজন্য যে, যখনই আবেগটি হাইকুতে রূপান্তরিত হয় ব্যক্তিগত আবেগ আর প্রকৃতির নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তির মধ্যে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। এভাবে বিশেষ আবেগ বা অভিজ্ঞতাকে প্রকৃতির মাধ্যমে সর্বজনীন করে তোলা হাইকুর বিশেষ গুণ হিসেবে বিবেচিত। হাইকু-মানসিকতার অধিকারী হতে হলে, একজন লেখককে অভিজ্ঞতার জন্যই একটি অভিজ্ঞতা অর্জনের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত থাকতে হয়। এর বাইরে অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকলে হাইকু মানসিকতা অকৃত্রিম থাকে না। এই লক্ষ্যে পৌঁছতে গেলে দ্রষ্টার সম্পূর্ণ অভিন্নতা অর্জন এবং একাত্মতা থাকার প্রয়োজন। মানুষের জীবনে দুঃখ, বেদনা এবং নিঃসঙ্গতা অনিবার্য বলে এসব ব্যক্তিগত অনুভূতিকে প্রকৃতির নৈর্ব্যক্তিক অভিব্যক্তির মাধ্যমে রূপান্তরিত করে অতিক্রমণ সম্ভব। সাধারণ অনুভূতি মহৎ বা নিগূঢ় চিন্তা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে পারে এ-প্রক্রিয়ায়। হাইকুর সৌন্দর্য এবং আকর্ষণ, ব্যক্তিক থেকে নৈর্ব্যক্তিকে রূপান্তরের এই ক্ষমতার জন্যই, লেখার শুরু থেকে আত্মার শান্তির আর মনের প্রশান্তি অর্জনের এক নির্মল মাধ্যম হাইকু পড়া আর লেখা। জাপানের পুরানো এবং আধুনিক সব কবিতার মধ্যে হাইকুই সবচেয়ে জনপ্রিয়। সপ্তদশ শতকে এর যে-যাত্রা শুরু হয়েছে তার ওপর আজ পর্যন্ত যবনিকাপাত হয়নি। বর্তমান সময়েও জাপানে হাইকুর চর্চা অব্যাহত রয়েছে। প্রতিটি শহরে হাইকু ক্লাব রয়েছে যার সদস্যরা নিয়মিত মিলিত হয়ে কবিতা পাঠ করে শোনায়। প্রকাশিত হাইকু-পত্রিকার সংখ্যাও অনেক। জাপানি এবং ইংরেজি পত্রিকায় হাইকু ছাপার জন্য প্রতি মাসে পত্রিকাতে স্থান নির্ধারিত থাকে। জাপান অতিক্রম করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হাইকু কবিতা লেখা হয়ে আসছে। টোকিওতে হাইকু মিউজিয়াম আছে, যেখানে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রকাশিত হাইকুর ওপর বই এবং পত্রিকা সংরক্ষিত রয়েছে। আর কোনো সাহিত্যিক ফর্ম নিয়ে এমন ব্যাপকভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আন্দোলন ও চর্চা হয়নি। হাইকু কেবল একটি সাময়িক শখের বিষয় নয়, এটি একটি অধ্যবসায় এবং নিরন্তর চর্চা যার পেছনে রয়েছে গভীর মনোনিবেশ এবং প্রকৃতির সঙ্গে অন্তরঙ্গ সংলাপ। দৈনন্দিন জীবনের বড় বড় ঘটনার পাশাপাশি প্রকৃতির সংস্পর্শে এসে যে আকস্মিক এবং সাধারণ অনুভূতির সঞ্চার হয় তাই-ই হয়ে ওঠে অসামান্য অনুভূতির উৎস। প্রকৃতি ও বিশ্বম-ল সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি। এর ফলে হাইকুতে প্রকৃতিপ্রেম, আধ্যাত্মিকতা এবং দার্শনিকতা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। হাইকুর বিভিন্ন পরতে অর্থের যে-বিভিন্নতা তার মধ্যে ঐক্যসূত্র থাকে, যার জন্য একটি পরতের অর্থ থেকে পরবর্তী পরতের অর্থের দিকে যাত্রা হয় সহজ ও স্বাভাবিক। এদিক দিয়ে বিবেচনা করলে হাইকুর অর্থোদ্ধার ধ্যানের পর্যায়ে পড়ে। এই ধ্যান মানুষকে বিবাগী করে না, জীবন ও জগৎ সম্পর্কে নতুন উপলব্ধির ভিত্তিতে মানসিক প্রশান্তি এনে দেয়। এই প্রশান্তিকেই বলা হয়েছে হাইকু অভিজ্ঞতা, মানসিকতার সৃষ্টি। ঠিক কবে প্রথম হাইকু কবিতা লেখা হয়েছে সে-সম্বন্ধে নির্ভরশীল তথ্য নেই। এক হিসাবে ত্রয়োদশ শতকের প্রথম দিকে হাইকু লেখা শুরু হয়। প্রথম যে-কবিতাটি ছাপা হয় সেটি স্থান পায় হায়াকুনিন ইস্সু ১২৩৫ খ্রিষ্টাব্দে বিখ্যাত টাংকা কবিতার সংকলনে। এই কবি ছিলেন ফুজিওয়ারা নো সাদাই-এ যিনি সংকলনটি গ্রন্থনা করেন। হাইকু কবিতা জনপ্রিয় হতে আরো আড়াইশো বছর লেগেছিল। পরবর্তী একশ বছরে আশি কাগা শাসনের অবসান হয় এবং সেইসঙ্গে যবনিকাপাত ঘটে গৃহযুদ্ধের। সাময়িকভাবে টয়োটমি হিদোওশির সংক্ষিপ্ত শাসনের শেষে প্রতিষ্ঠিত হয় তোকুগাওয়া শোগুনের সামরিক শাসন। এই সময়টা এমন ছিল না যখন সূক্ষ্ম অনুভূতি-নির্ভর কবিতা লেখা যেতে পারত যার জন্য হাইকু চর্চায় উন্নতি না হয়ে কিছুটা অবনতিই হয়। তোকুগাওয়া হিদোয়োশি টয়োটোমি শাসনের সময় যে-গৃহযুদ্ধ চলে তার শেষে তোকুগাওয়া পর্বে কঠোরভাবে আরোপিত শান্তির পরিস্থিতি নতুন করে হাইকু লেখার পরিবেশ ও মানসিকতা সৃষ্টি করে। তেইতোকুর শিষ্য তেইশিতসু ইয়োশিনিতে সর্বজননন্দিত চেরি ব্লসম দেখে আসার পর তাকে যখন প্রশ্ন করা হয় তিনি কি দেখার পর হাইকু লিখেছেন, তখন তার উত্তর ছিল : ওহ! শুধু ফুটন্ত ফুলে আবৃত ইয়োশিনোর পাহাড়। এখানে হাইকু কবিতার নির্যাস রয়েছে বলে মনে করেছেন অনেকে। কিন্তু তবু হাইকুর প্রকৃত চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য জানার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে সোয়েন নামক কবির প্রতিষ্ঠিত দানরিন স্কুলের জন্য। সোয়েন এবং এই স্কুলের কবিদের কবিতাই হাইকুর সম্ভাবনা সম্বন্ধে আভাস দিয়েছিল। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত হাইকু কবিতার উৎকর্ষ সাধিত হয় চারজন কবির লেখায়। এঁদের কবিতার ভিত্তিতে গড়ে ওঠে হাইকু কবিতার নান্দনিকতা, সৌন্দর্যবোধ এবং দার্শনিকতা। হাইকু কবিতার ঐতিহ্য নির্মিত হয়েছে এঁদেরই কাব্যচর্চায়। আধুনিক হাইকু কবিদের কাছে এই চারজন আদর্শ হাইকু কবি এবং সেই জন্য তাঁরা স্মরণীয় এবং অনুসরণীয়। ১৬৩৮ খ্রিষ্টাব্দে তোকুগাওয়া শোগুনের সামরিক সরকারের সময় শান্তিপূর্ণ জাপান বহির্বিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ছিল। এই পর্বেই ১৬৪৪ সালে জন্ম নেন মাতসুও বাশো, হাইকু কবিতার সম্রাট। তাঁর সমকালে কবি-প্রতিভা বিকাশের উপযোগী পরিবেশ ছিল। সকল শ্রেণির মানুষের জন্য জীবন ছিল স্থিতিশীল এবং সুরক্ষিত। সামুরাই যোদ্ধা শ্রেণিযুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হতে না পেরে শিল্পকলার প্রতি মনোযোগ দেওয়ার সময় পায়। এই শিল্পকলার মধ্যে কবিতাই ছিল সবচেয়ে জনপ্রিয়। আট বছর বয়সে বাশোকে এক অভিজাত গুরুর দুর্গে তার ছেলে সেনজিনের সহচর হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। বাশো তাঁর গুরু সহচর সেনজিনের এবং সেনজিন তাঁর গুরু কিগিনের কাছ থেকে কবিতা লেখা শেখেন। তাঁর প্রথম উল্লেখযোগ্য কবিতা লেখা হয় তেরো বছর বয়সে। কবিতাটি ছিল সমকালীন কবিতার ক্যারিকেচার, যার জন্য এর কাব্যমূল্য খুব বেশি ছিল না। ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দে বাশোর গুরু সেনগিনের মৃত্যু হয়। ভগ্নহৃদয়ে বাশো কোয়াসান মাঠে গিয়ে সাংসারিক জীবন ত্যাগ করেন। এর বিশ বছর পর তিনি যখন তাঁর প্রাক্তন গুরুর দুর্গে যান এবং যে চেরি গাছের নিচে তাঁরা খেলা করতেন সেখানে দাঁড়ান। এরপর বাশো কিয়োতো শহরে গিয়ে কিগিনের অধীনে হাইকু লেখার চর্চায় মনোনিবেশ করেন। তিরিশ বছর বয়সে তিনি নিজের হাইকু স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তখনো তাঁর কবি-প্রসিদ্ধি ছড়িয়ে পড়েনি। তিনি এই সময় হাইকু ছাড়াও ‘রেঙ্গা’ কবিতা লেখেন। ১৬৭৯ সালে তিনি নতুন শৈলীর অনুসরণে প্রথম হাইকু লেখেন। এই আঙ্গিক হাইকু কবিতায় গভীরতা সৃষ্টি করে যে-গভীরতা থেকে সূক্ষ্ম চিন্তা এবং কল্পনা গড়ে ওঠে। বাশো নিজে সব সময় ‘অভ্যন্তরীণ তুলনার’ এই আঙ্গিক অনুসরণ করেননি কিন্তু তাঁর পরবর্তী হাইকুতে অভ্যন্তরীণ তুলনার অন্তত ইঙ্গিত রয়েছে। যেমন চেরি ব্লসমবিষয়ক হাইকুতে চেরি ব্লসমকে তুলনার পটভূমি এবং তারা কী স্মরণ করায়, উভয় বিষয় মনে করিয়ে দেয়। কাকের ওপর লেখা হাইকুটি যখন লেখা হয় বাশো আপাতদৃষ্টিতে যেসব বস্তু সুন্দর নয়, সেখানে সৌন্দর্যের অনুসন্ধান করছিলেন। দুই বছর পর ১৬৮১ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর জীবনে একটা বড় পরিবর্তন আসে। তিনি ঘোষণা করেন যে, জীবন বড় বেশি জাগতিক বন্ধনে বাঁধা পড়েছে। এই উপলব্ধির পর তিনি ধ্যানের মাধ্যমে জৈন বৌদ্ধধর্মের অনুশীলন শুরু করেন। এরপর জীবনের শেষ দশ বছরে তাঁর সবচেয়ে সুন্দর ও অর্থময় হাইকুগুলি লেখা হয়। ১৬৮৬ সালে তিনি জাপানি ভাষায় লেখা সবচেয়ে পরিচিত হাইকুটি লেখেন যা তাঁর নিজের কাছেই কাব্যচর্চায় এক বড় মোড় নেওয়া বলে মনে হয়েছে। হাইকুটি প্রতারকভাবে সরল, অনুবাদে এই রকম : পুরানো পুকুর ব্যাঙের ঝাঁপ পানির শব্দ। অনেক পণ্ডিত-সমালোচক এই হাইকুটিতে গভীর এবং উচ্চমার্গীয় অর্থের সন্ধান পেয়েছেন। আবার কারো কাছে একে মনে হয়েছে রহস্যাবৃত ধাঁধার মতো। বাশো যখন কাছেই ব্যাঙের লাফের শব্দ শোনেন, সেই সময় সঙ্গে সঙ্গে হাইকুর শেষের দুটি লাইন মনে আসে বলে সে দুটি সমাপ্তিসূচক বলে ধরা হয়। শিষ্যদের সঙ্গে আলাপের পর তিনি প্রথম লাইন হিসেবে যোগ করেন ‘পুরানো পুকুর’। আঙ্গিকের দিক দিয়ে হাইকুটি ‘কাক’বিষয়ক হাইকুর মতো কিন্তু কাক এবং হেমন্তের সন্ধ্যার তুলনায় পুরনো পুকুর এবং হঠাৎ শব্দের মধ্যে ‘অভ্যন্তরীণ তুলনাটি’ আরো গভীর ও সূক্ষ্ম। কবিতাটি জীবন সম্বন্ধে যে-দৃষ্টিভঙ্গি বা ধারণার সৃষ্টি করে তা ‘কাক’ হাইকুতে দেখা যায় না। যদি বাশো একমাত্র এই হাইকুটি লিখতেন তাহলে এর ভেতরই হাইকুর সব গভীর অর্থ তিনি রেখেছেন কিনা সেই মর্মে জল্পনা-কল্পনা হতে পারত। কিন্তু বাশো যে পরবর্তী অধিকাংশ হাইকুতে সচেতন বা অর্ধসচেতনভাবে হাইকুর সব অর্থ নিহিত রেখেছেন তার সপক্ষে যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। এই হাইকুগুলি যতই পড়া যায় তাদের প্রতিটিতে গভীর অর্থের উপস্থিতি উপলব্ধি হয়। এমনও মনে হয় যে, তাদের সবগুলির সমাহারে হাইকু সমগ্রতা পেয়েছে। জাপানিদের মতে, বাশো জৈন বৌদ্ধধর্ম দ্বারা এত অনুপ্রাণিত হন যে, প্রতিটি কবিতায় এর প্রভাব পড়েছে। হয়তো এই ব্যাখ্যা সঠিক কিন্তু কেউ জৈন-চেতনা কী তার ব্যাখ্যা দেননি। জৈন ধর্মে বোধি লাভ বা সাতোরি অর্জন একটি শক্তিশালী আবেগের অনুভব করা সমান যা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। একে বলা হয়েছে বাস্তবতাকে উপলব্ধি করা। খ্রিষ্টান ধর্মের বিশেষজ্ঞদের মতে একে বলা যায় প্রকৃতিভিত্তিক। যারা জৈন ধর্মের অনুসারী নন, তারা বাশোর জীবনে ও কবিতায় এই চেতনার ভূমিকা সম্বন্ধে বিশ্লেষণ করেছেন। তাঁর জৈন চেতনার বৈশিষ্ট্য এবং পরিচায়ক হিসেবে যা মনে করা হয় তার মধ্যে রয়েছে জীবনতৃষ্ণা, প্রতিটি মুহূর্ত পূর্ণভাবে ব্যবহার করা, প্রাকৃতিক বস্তুতেও এর প্রভাব উপলব্ধি করা, কিছুই বিচ্ছিন্ন নয় বলে ভাবা, সবকিছুই গুরুত্বপূর্ণ, সহানুভূতির ব্যাপকতা, সব ধরনের সম্পর্ক সম্বন্ধে তীক্ষè সচেতনতা। এসব বৈশিষ্ট্য এবং গুণ জৈনধর্ম-উদ্ভূত কিনা তা জোর করে বলা না গেলেও বাশোর হাইকুতে তাদের উপস্থিতি সম্বন্ধে নিঃসন্দিহান হওয়া যায়। কিন্তু জৈন চেতনা যাই হোক না কেন তার সংখ্যাগরিষ্ঠ হাইকু ধর্মবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত নয় বলেই মনে হয়। এগুলি বাস্তব দৃশ্য এবং ঘটনার সরল বর্ণনা যেখানে এইটুকু তথ্যই দেওয়া হয়েছে যার ভিত্তিতে পাঠক বাশোর ভূমিকা নিয়ে তার আবেগগুলি উপলব্ধি করতে পারে। সারাসিনো কিকো নামের গদ্যের বই ছাড়াও বাশো গদ্যে অন্যান্য বই লিখেছেন। এর মধ্যে বিখ্যাত হলো ন্যারো রোডস ইন ওকু যেখানে তিনি পদব্রজে ছয় মাস গ্রামাঞ্চলে যাত্রা অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেছেন গদ্যে এবং কবিতায়। ১৬৮৯ খ্রিষ্টাব্দে এদো থেকে যাত্রা করে আইসের সূর্যদেবীর মন্দিরে শেষ হয় এই যাত্রা। বইটিতে তার পঞ্চাশটি হাইকু আছে যার অধিকাংশই বিখ্যাত হয়ে গেছে। বইটি জাপানি সাহিত্যে একটি মূল্যবান সংযোজন বলে বিবেচিত। ১৬৯৪ সালে বাশোর মৃত্যু হয়, তখন তিনি দেশের ভেতর ভ্রাম্যমাণ। অসুস্থ অবস্থায় রাত্রিযাপন করে তিনি শিষ্যদের সকালে কাছে ডেকে রাতে দেখা স্বপ্নের ভিত্তিতে লেখা তাঁর শেষ হাইকুটি শোনান : ভ্রমণে বেরিয়ে, অসুখ, মাঠে মাঠে সবকিছু বিশুষ্ক স্বপ্ন তবুও হেঁটে যায়। এর চেয়ে হৃদয়স্পর্শী বিদায় বেলার উপহার আর কিছু হতে পারত না। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে হাইকু জগতের শ্রেষ্ঠ কবি ছিলেন তানিগুচি বুশো। তাঁর খ্যাতি ছিল বাশোর সমতুল্য। তাঁর জীবন সম্বন্ধে খুব বেশি কিছু জানা যায় না, লেখা কবিতার ভিত্তিতেই তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে অনুমান করতে হয়। জাপানি সমালোচকদের মতে, বাশো এবং বুশো দুজনেই ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। তারা দুজনে দুই ভিন্ন মেরুর মানুষ ছিলেন, অন্তত কবি হিসেবে। বুশোর প্রতিভা ছিল বহুমুখী, কোনো অর্থেই তিনি মরমিয়া ছিলেন না এবং জাগতিক বিষয়ে উদাসীনও নয়। বাশোকে যদি বলা হয় মুক্তা, বুশোকে তুলনা করতে হয় হীরকখ-ের সঙ্গে। বহুরূপী হওয়ার জন্যই বুশোর যে-কোনো হাইকুকে প্রতিনিধিত্বমূলক বলা কঠিন। কিন্তু একই বিষয়ে লেখা দুটি হাইকু বিবেচনা করলে তাঁর কবিতার গুণ ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ধারণা করা যায়। এই প্রসঙ্গে প্লাম ফুলের ওপর লেখা হাইকুর দৃষ্টান্ত দেওয়া যায় : প্লাম গাছে ফুটন্ত ফুল সুগন্ধ কি উপরে উঠছে? চাঁদের চারিদিকে গোল বৃত্ত। কবিতাটিতে চমৎকার কল্পনা আছে, একটি আকর্ষণীয় চিত্র আঁকা হয়েছে। এর পাশেই একই বিষয়ে লেখা হাইকুটি এমন : প্লাম ফুল ফুটেছে বারবনিতারা কিনছে নতুন ওড়না বেশ্যালয়ের একটি ঘরে। এখানে একটি বর্ণিল দৃশ্যের ছবি আঁকা হয়েছে, কোনো অস্পষ্টতার আশ্রয় না নিয়ে। হাইকু বৈশিষ্ট্য শেষের কবিতায় সেজন্য কিছুটা কম। বসন্তের বৃষ্টি নিয়ে বুশো তিরিশটি কবিতা লিখেছিলেন। মে-জুন মাসের বৃষ্টির তুলনায় বসন্তের বৃষ্টি বেশ শান্ত এবং কোমল। এ-বিষয়ে লেখা দুটি কবিতা : বসন্তের বৃষ্টি একসঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত খড়ের রেইনকোট আর ছাতা। রেইনকোটটি অবশ্যই একজন পুরুষ পড়েছে, ছাতাটি মেয়ের হাতে, এটা মনে রাখলে চিত্রটি পূর্ণতা পায়। একই বিষয়ে দ্বিতীয় কবিতা : বসন্তের বৃষ্টি গাড়িতে দুজনে বসে প্রিয় সঙ্গিনীর ফিসফিস স্বর। যে-দুটি চরিত্রের উল্লেখ করা হয়েছে কবিতায় তারা অভিজাত শ্রেণির কেননা, গাড়িতে তারাই চড়তো। দ্বিতীয় হাইকুর তুলনায় প্রথমটি চিত্রগুণে এবং ব্যঞ্জনায় অনেক সুন্দর। ওপরের দৃষ্টান্ত বুশোর কবিতায় বৈচিত্র্য সম্বন্ধে সব ধারণা দেয় না, কিন্তু হাইকুগুলি পড়ে বাশোর সঙ্গে তাঁর পার্থক্য বেশ বোঝা যায়। তাঁর কবিতায়ও গভীরতা আছে, কিন্তু বাশোর হাইকুর মতো নয়। যদি দার্শনিক ব্যাখ্যা দেওয়া হয় বুশোর হাইকুর তাহলে তা সঙ্গে-সঙ্গে গ্রহণযোগ্য মনে হবে না। তবে বুশোর অনেক কবিতাই প্রকৃতির সৌন্দর্য, রহস্যময়তা এবং তার জন্য বিস্ময় প্রকাশ করে লেখা। কিন্তু এই উপলব্ধি এতটাই কথার ব্যঞ্জনার ওপর নির্ভর করে যে-অনুবাদে তা হারিয়ে যায়। যে হাইকু আক্ষরিকভাবে অনুবাদ করা যায় তার সম্বন্ধেও এই কথা বলা চলে : চেরি ফুল চলে গেছে গাছের ভেতর একটি মন্দির এখন সেটাই চেরির কথা বলে। এই হাইকুতে কিছুটা বৌদ্ধধর্মের প্রভাব আছে, কিন্তু কাব্যিক দ্যোতনা তা অতিক্রম করে গিয়েছে। প্রকৃতপক্ষে বুশোর দর্শন সম্বন্ধে অল্পই জানা যায় কেননা, তাঁর কবিতা এবং কিছু চিত্রকর্মের বাইরে তিনি বিশেষ কিছু বলেননি। তিনি যে পরিবর্তনশীল প্রকৃতির শোভা উপভোগ করেছেন তা বেশ বোঝা যায়, যদিও একজন দর্শক হিসেবে, প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নয়। প্রকৃতির সৌন্দর্য কীভাবে উপভোগ করা যাবে সে-সম্বন্ধে তাঁর নিজের ধারণা ছিল : চেরি ফুল দেখতে এলাম গাছের নিচে ঘুমিয়ে পড়ি কোনো কাজ নেই। এখানে প্রকৃতির শোভা দেখার জন্য খুব বাড়াবাড়ি করার কথা বলা হয়নি, জাপানি সৌন্দর্যবোধের যা একটা বৈশিষ্ট্য। মনে হয় তিনি বলছেন অবসর উপভোগের জন্য চেরি ফুল দেখার প্রয়োজন হয় না, কবিতা লেখারও না। বুশো তাঁর কবিতার বিষয়ের মতো আঙ্গিক নিয়েও সমানভাবে আগ্রহ দেখিয়েছেন। আঙ্গিকের ওপর তাঁর পরিপূর্ণ দখল ছিল এবং এর ব্যবহারে ছিল অগাধ তৃপ্তি। তাঁর আগের কোনো হাইকু কবির তুলনায় এই আঙ্গিকের ওপর ভিত্তি করে তিনি শব্দ, বর্ণ এবং পাশাপাশি একই ধ্বনির ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্যের জন্য তাঁর বেশ কিছু উৎকৃষ্ট কবিতার অনুবাদ কঠিন হয়ে পড়েছে। যেমন : দিনের বেলায়, ‘দিন চলে যাও’ ‘অন্ধকার থেকে আলোয় এসো’ বাতিগুলো তাই বলছে। মূল জাপানিতে কবিতাটির যে-সৌন্দর্য তা এখানে পাওয়া যায় না। তাঁর একটি হাইকু যার অনুবাদ প্রায় দুষ্কর সেটি এমন : বসন্তের সমুদ্র সারা দিন ওঠানামা খুব শান্ত হয়ে। জাপানিতে ‘হিনেমস নোটারি নোটারি কোনায়’ বাক্যবন্ধে যে-সংগীত বা ছন্দ তা অনুবাদে আনা যায় না। বুশো ধ্বনিকে অর্থের সঙ্গে এমনভাবে মিলিয়েছেন যে হাইকুটি লেখার পর তা এত বিদ্ঘুটে মনে হয়, একে হাইকু বলা যাবে কিনা এ বিষয়ে সংশয় জাগে : চাঁদের আলোয় পশ্চিমে পারাপার পুব দিকে চেরি ফুলের ছায়া ধীরে ধীরে যায়। এই হাইকুতে ৫, ৭, ৫ সিলেবলের পরিবর্তে ১১, ৮, ৫ সিলেবল রয়েছে। এই কবিতায় অর্থের যে-সমান্তরলতা তার সঙ্গে চীনা কবিতার মিল বেশ স্পষ্ট। অনেক কবি এই হাইকুর উল্লেখ করে বলেছেন, হাইকু ৫, ৭, ৫ সিলেবলের নাও হতে পারে। বলা বাহুল্য, এই মত সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি। বুশোর কৃতিত্ব তিনি খুব অল্প কথায় বিষয়গুলি ব্যক্ত করেছেন। যেমন, একটি হাইকু : উপহার দিতে এসেছে ট্রাউট মাছ, ভেতরে না ঢুকে চলে যায় মধ্যরাতের বন্ধ ফটক। কবিতাটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে একজন লিখেছেন, কোনো ব্যক্তির গৃহে প্রবেশের ফটকে আমরা প্রথমে মধ্যরাতে কণ্ঠস্বর শুনতে পাই। গৃহস্বামী উঠে দেখেন চেনা একজন ট্রাউট মাছ তাকে উপহার দিতে এনেছে। যদিও তাকে ভেতরে আসতে বলা হয়, সেই বন্ধু অনেক রাত হওয়ার কারণে চলে যায়। এই চিত্রটি পাঠককে নির্মাণ করে নিতে হয় এবং চিত্রটি সম্পূর্ণ হওয়ার পর যে-অনুভূতি জেগে থাকে তা হলো বন্ধুত্বের এবং সঙ্গদানের। বুশো একই আঙ্গিক ব্যবহার করেন বেশ সার্থকভাবে অন্য এক কবিতায় : ‘রাতের আবাস’ ডাক দেয় তরবারি রেখে বাতাসে ওড়ে বরফ। এখানে বাতাসে ওড়া বরফ তিনটি কাজ করে : ১/ঋতুর পটভূমি সৃষ্টি, ২/ আগন্তুকের সঙ্গে ভেতরে ঢোকা, ৩/ আগন্তুকের সঙ্গে গৃহের মালিকের তুলনা এবং তার সঙ্গে আগন্তুকের। বুশো একজন চিত্রশিল্পী ছিলেন যার জন্য তাঁর পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা ছিল গভীর। তাঁর হাইকুর পরিবেশ আকর্ষণীয় চিত্র আঁকে সাবলীল গতিতে। কিন্তু বিদেশিদের জন্য এসব হাইকুর চিত্রময়তা উপভোগ করতে হলে জাপানি চিত্রকলা সম্বন্ধে জ্ঞান থাকতে হবে। যেমন এই কবিতায় : একটা লাইন ধরে তারা ঘোরে বুনো হাঁসগুলো, পাহাড়ের পাদদেশে চাঁদ যেন সিলমোহর আঁকা। শুধু পড়ে বোঝার উপায় নেই যে, হাঁসগুলো সমান্তরালে উড়ছে না, নেমে আসছে পাহাড়ের উঁচু থেকে, যদিও তাদের অবস্থান চাঁদ এবং পাহাড়ের পাদদেশের ওপরে। জাপানি চিত্রকলায় দৃশ্যের এমন বৈশিষ্ট্য থাকে যা না জানা থাকলে হাইকুটির দৃশ্যগত সৌন্দর্য উপভোগ করা কঠিন। সব হাইকু কবির মধ্যে ইস্সা ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। তিনি বাশোর মতো সন্তপুরুষ ছিলেন না, বুশোর মতো হরফের কৌশলী কারিগরও না। তিনি ছিলেন একান্তভাবেই একজন মানবিক হৃদয়ের মানুষ। বাশো যদিও শ্রদ্ধার পাত্র তাঁর হাইকুর দার্শনিকতা তাঁর উপলব্ধিতে প্রয়াসসাধ্য করে। আর বুশোর প্রতিভা উজ্জ্বল হলেও তিনি বেশ নিরাসক্তভাবে কাব্যচর্চা করে গিয়েছেন যার জন্য জনপ্রিয় হতে পারেননি। ইস্সা তাঁর সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও যেসব হাইকু লিখেছেন তার মাধ্যমে নিজের হৃদয়ের দরজা খুলে দিয়েছেন যার জন্য হতে পেরেছেন পাঠকপ্রিয়। ইস্সার শৈশব ছিল বেশ দুঃখের এবং কষ্টের। মাতৃস্নেহ-বঞ্চিত তাঁকে ভুগতে হয়েছে দারিদ্র্যের কশাঘাতে। কথিত আছে, শৈশবে তাঁর ছেঁড়া কাপড় দেখে ছেলেমেয়েরা তাঁকে খেলায় নেয়নি। একা বসে থাকতে তিনি ছোটো একটা চড়ুইয়ের বাচ্চা দেখতে পান যার অবস্থা দেখে তার খুব মায়া হয়। তখন তাঁর তেরো বছর বয়স, তিনি লেখেন : এসো, আমরা এক সঙ্গে খেলি ওহে বাচ্চা চড়ুই মাতৃহীন তুমি। কবিতাটি লেখার পরই তিনি কেঁদে ফেলেন। নয় বছর বয়সেই তিনি এমন হাইকু লিখেছিলেন কিনা সে-বিষয়ে কোনো নিশ্চিতি নেই। চৌদ্দ বছর বয়সে তাঁর বাবা তাঁকে বাড়ির বাইরে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। এরপর বিশ বছর তিনি বাইরে ছিলেন, বেশিরভাগই এদোতে। কখনো উৎফুল্ল, কখনো বিষণœ থেকেছেন তিনি। দারিদ্র্য পিছু ছাড়েনি তাঁর। ১৮১১ সালে বাবার মৃত্যুর পর পৈতৃক সম্পত্তি পেলেও সৎমা ও ভাইদের ষড়যন্ত্রে তেরো বছর পর্যন্ত তা উপভোগ করতে পারেননি। তিনি এদোয় ফিরে যান এবং কবি হিসেবে তাঁর বিকশিত প্রতিভা প্রশংসা অর্জন করে। কিন্তু বাড়ির জন্য পিছুটান তাঁকে কয়েকবারই নিজের গ্রামে নিয়ে যায়। একবার গ্রামে যাওয়ার পর তিনি লেখেন : যেখানে আমার জন্ম যেখানে আমি আসি, যেসব স্পর্শ করি কেবলই কাঁটার ফুল। এখানে ইস্সা তাঁর মনের বেদনার কথা বলছেন, একই শিরোনামে লেখা হাইকুতে বুশো বিজ্ঞ লোকের মতো তাঁর অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন যা তুলনায় অনুজ্জ্বল। শেষ পর্যন্ত ইস্সা পৈতৃক সম্পত্তি পেয়ে যান এবং সঙ্গে সঙ্গে এদো ত্যাগ করে গ্রামের বাড়িতে আসেন। তখন তিনি নতুন মানুষ, তাঁর মনের ভেতরকার তৃপ্তি চলে গিয়েছে। গ্রামের বাড়িতে প্রথম নববর্ষে লেখা তাঁর হাইকু : একটা অদ্ভুত, বড় অদ্ভুত ব্যাপার যে ঘরে আমি জন্মাই আজ সকালে সেখানে বসন্ত। তাঁর পারিবারিক জীবন সুখের ছিল না, অল্প বয়সে স্ত্রী মারা যান, তারপর পাঁচটি সন্তান। নিজেও প্রায়ই অসুস্থ থাকতেন। একটি মৃত সন্তানের উদ্দেশে লেখা হাইকু ছিল এই রকম : শিশির মুছে যায় ‘পৃথিবীটা নোংরা এখানে আমাদের করার কিছু নেই।’ প্রথম লাইনটি একটি ধর্মগ্রন্থ থেকে নেওয়া। জীবনের নশ্বরতার সঙ্গে শিশিরকুার অস্থায়ীত্বের তুলনা করা হয়েছে এখানে। কিন্তু ইস্সা বিশ্বজনীন চিন্তায় প্রবেশ করেননি, তাঁর চিন্তার লক্ষ্য ছিল মৃত সন্তান। ইস্সার অসুখী মানসিকতার পেছনে কেবল জীবনের নিষ্ঠুর অভিজ্ঞতা ছিল না, দার্শনিক এবং ধর্মীয় অস্থিরতাও এর পেছনে কাজ করেছে। তিনি বুশোর মতো নিরাসক্ত হতে পারেননি। সমকালীন বৌদ্ধধর্মে তিনি শান্তি খুঁজে পাননি। প্রকৃতপক্ষে প্রচলিত কোনো কিছুই তাঁকে শান্তি দিতে পারেনি। জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে ‘ডেথ-পোয়েম’ নামে পরিচিত হাইকুতে : হাত ধোয়ার পাত্র থেকে হাত ধোয়ার পাত্রে আমার যাত্রা শুধুই জটিলতা। কবিতাটির দুটি অর্থ আছে। প্রথমত তিনি বলতে চেয়েছেন, সারাজীবন আমি অর্থহীন কাজ করেছি। দ্বিতীয় অর্থটি গভীর। এখানে তিনি বলছেন যে, জীবনের অর্থ আছে, কিন্তু তা বোঝার উপায় নেই। ইস্সা পিওর ল্যা- বৌদ্ধধর্মের সদস্য ছিলেন এবং ধর্মপ্রাণ হয়ে জীবনযাপন করতে চেয়েছিলেন। আমিদা বৌদ্ধের জন্য অসীম ভালোবাসার মিশ্রণ ঘটেছিল তাঁর প্রিয় সব দুর্বল প্রাণীর সঙ্গে : শিশু, বিভিন্ন প্রাণী, পোকামাকড়। এদের সম্বন্ধে লেখা হাইকুতে তিনি যে বিষয়ের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গিয়েছেন সেই উপলব্ধি হয় পাঠকের। যেমন: শুকনো ব্যাঙ লড়াই বন্ধ করো না ইস্সা এখানে আছে। তিনি অবশ্য আমিদা বৌদ্ধের প্রচলিত পদ্ধতির অনুসারীদের সঙ্গে একাত্ম হতে পারেননি। তাঁর ধারণায় তারা আমিদা বুদ্ধের শিক্ষা বিকৃত করে আচারসর্বস্ব হয়ে গিয়েছিল। তিনি বিশ্বাস থেকে যেসব ধর্মভিত্তিক হাইকু লেখেন সেখানে এই প্রতীতি রয়েছে যে, আমিদা বুদ্ধকে বিশ্বাস করাই প্রকৃত ধর্ম। এই ধর্মীয় চেতনা থেকে লেখা তাঁর একটি হাইকু : শিশির অশ্রুর সঙ্গে মিশে আছে ঘুঘুরা প্রার্থনা করে মৃদু স্বরে বুদ্ধই পরিত্রাতা। ইস্সা সমাজ-সচেতন ছিলেন। সমাজের উঁচু-নিচু ভেদাভেদ তিনি মানতে পারেননি। কিন্তু এর বিরুদ্ধে কিছু করার ক্ষমতাও তাঁর ছিল না। সামন্তপ্রভুদের তিনি খুব একটা পাত্তা দিতেন না, ময়লা এবং ছেঁড়া কাপড় পরে ঘুরতেন সাধারণ মানুষের একজন হয়ে। এসব ছাড়া সামাজিক সাম্য আনার জন্য বাস্তবে কিছু করা সম্ভব হয়নি তাঁর পক্ষে। তাঁর কিছু হাইকু সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে লেখা : একজন সামন্তপ্রভু কে তাকে ঘোড়া থেকে নামায়? চেরি ফুল। এক অর্থে চেরি ফুল এখানে সাম্যের প্রতীক। তার কাছে সবাই সমান। তার সৌন্দর্য দেখতে সামন্তপ্রভুকেও ঘোড়া থেকে নামতে হয়। কিন্তু এর অন্য অর্থও আছে। সামন্তপ্রভুকে দেখলে সাধারণ মানুষকে যে ঘোড়া থেকে নেমে পড়তে হতো তাঁর ইঙ্গিতও রয়েছে এখানে। হাইকুটি দ্ব্যর্থবোধক। শৈলীর প্রসঙ্গে ইস্সার কথা বলতে গিয়ে একজন সমালোচক বিউসা সুমোদা বলেছেন, তাঁর হাইকু দ্বি-মাত্রিক যার বিপরীতে বাশো লিখেছেন ত্রি-মাতৃক হাইকু। ইস্সার দ্বি-মাত্রিক হাইকুর দৃষ্টান্ত : বরফ গলছে গ্রাম ভেসে যাচ্ছে অসংখ্য শিশু। প্রথম দুই লাইনে যে-অর্থ তা প্রাকৃতিক দুর্যোগের, তৃতীয় লাইন যুক্ত হতেই উৎসবের মাত্রা এসে গেল। গ্রাম ভেসে গিয়েছে বরফগলা পানিতে নয়, অসংখ্য শিশুর ভিড়ে। ইস্সা যে খুব কৌশলী হয়ে হরফের কারিগরি করেছেন, তা নয়। দ্ব্যর্থবোধক শব্দ ব্যবহার করে অনেক সময় তিনি জটিলতার সৃষ্টি অবশ্য করেছেন। যেমন : মানুষ? বলতে পারি না; একটাও সোজা হয়ে দাঁড়ানো কাকতাড়–য়া দেখি না এখন। ঊনবিংশ শতাব্দীর বেশিরভাগ সময়ই ছিল হাইকুর জন্য খারাপ সময়। যখন ইস্সা মারা যান, তিনি কোনো স্কুল রেখে যাননি। আর বুশোর অনুসারীরা তাঁর বলিষ্ঠ ব্যক্তিত্বের অধিকারী না হওয়ার জন্য একধরনের মেকি কবিতাচর্চায় ঝুঁকে পড়ে। শতকের শেষ দিকে এই মেকি হাইকুচর্চার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু হয় সামাওকা শিকির নেতৃত্বে। জাপান তখন ক্রান্তিকালের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, পুরনো প্রতিষ্ঠান ও পদ্ধতির সঙ্গে পাশ্চাত্য থেকে আনা ধ্যান-ধারণার সংঘর্ষ চলছিল। প্রশিক্ষণ এবং মেজাজ, দুই দিক দিয়েই শিকি নতুন সাহিত্য-আন্দোলনে নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য উপযুক্ত ছিলেন। তাঁর কৈশোরে সামাজিক পরিবর্তনের প্রক্রিয়া অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল এবং নানা ধরনের উত্থান ও বিপ্লবের সতর্কবাণী শোনা যাচ্ছিল। ১৮৭৭ সালে সাতশুমা বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে এই অস্থিরতার সমাপ্তি ঘটে। তার আগেই শিকি বেশ কয়েকটি স্কুলে ভর্তি হয়েছেন এবং পড়েছেন, তাঁর শিক্ষার ধারাবাহিকতা কমই ছিল। কৈশোরের এসব অভিজ্ঞতা তাঁর ভেতর সৃষ্টি করেছিল অস্থিরতা, যা পরবর্তীকালে তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হয়ে যায়। শিকি মাত্র এগারো বছর বয়সেই লেখা শুরু করেন এবং ষোলো বছর পর্যন্ত পারিবারিক পরিম-লে হাইকুচর্চা অব্যাহত রাখেন। এরপর তিনি টোকিও চলে যান এবং সেখানে হাইকু প্রশিক্ষণ নেওয়ায় মনোনিবেশ করেন। স্কুল-কলেজের পড়া অসমাপ্ত রেখে তিনি নিহোন পত্রিকায় যোগ দেন। এই পত্রিকায় তাঁর লেখা অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এক বছরের মধ্যে তিনি ‘বাশোর সমালোচনা’ শীর্ষক হাইকু লিখে সাড়া জাগিয়ে ফেলেন। কবিতাটিতে তিনি সরাসরি বাশোকে আক্রমণ করেননি, কেবল পুরানো ঐতিহ্যের প্রতি নতুন প্রজন্মের বিরোধিতার পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর মতে, বাশোর চার-পঞ্চমাংশ কবিতাই গুণগতভাবে নিম্নমানের, যে-মন্তব্য অনেকের কাছে অবিমৃশ্যকারিতার সমান বলে মনে হয়েছে। এই বিতর্কের ফলে তাঁর লেখা রাতারাতি আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে। পরে অবশ্য শিকি বাশো সম্পর্কে তাঁর মতামত সংশোধন করেছিলেন। নতুন প্রজন্মের মধ্যে লেখালেখির মাধ্যমে শিকি একটি অনুসারী দল গড়ে তোলেন। এদের লক্ষ্য ছিল অতীতের জ্যেষ্ঠ কবিরা হাইকু লেখা সম্বন্ধে যেসব রীতি ও পদ্ধতি গড়ে তুলেছেন তার বিরোধিতা করা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল নতুন কিছু করার বাসনা। দুশো বছর আগে রানমেটসু নামে এক হাইকু কবি লিখেছিলেন : হলুদ ক্রিসেনথিমাম! হলুদ সাদা ক্রিসেনথিমাম! অন্যসব নাম – আর যদি না থাকতো! শিকি এর উত্তরে লিখলেন : ক্রিসেনথিমাম! সত্য বটে হলুদ, সাদা কিন্তু আমি চাই একটি লাল রঙেরও। শিকি শুধু অতীত ঐতিহ্যের বিরোধিতা নয়, নতুন স্কুলও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। তাঁর এই উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। নতুন কবিদের তাঁর দেওয়া উপদেশের মধ্যে ছিল : পুরানো নিয়মকানুন নিয়ে ভেবো না। ব্যাকরণ নিয়েও মাথা ঘামানোর কিছু নেই। বানান নিয়ে ও নয়। প্রয়োজন শুধু মনোনিবেশ। দীর্ঘদিনের নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যে দিয়ে কর্মব্যস্ততার মুখোমুখি হয়ে বিভিন্ন হাইকু কবিদের বই পড়ে ও বাস্তবতা থেকে আমার হৃদয়ের ভাব আবেগ মিশিয়ে আমি আমার মনের ভাবগুলো হাইকুরূপে ‘বাংলা হাইকু’ বইটিতে প্রকাশ করেছি। আমার আগের লেখা বইগুলো পাঠক-পাঠিকার কাছে পৌঁছে দিতে পেরে আমি আন্তরিকভাবে আনন্দিত। পাঠক-পাঠিকার কাছে আমার প্রচেষ্টা সার্থক হবে তখনই যখন আমার এই বইটি পড়ে অনুপ্রাণিত হবে এবং মজা খুঁজে পাবে আমার পাঠক-পাঠিকা । এই বইটি লেখা সত্ত্বেও হয়তো অনেক খুঁতই রয়ে যাবে। আশা করি পাঠক-পাঠিকা আমাকে মার্জনা করবেন। ‘বাংলা হাইক’ যে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পাঠকদের জন্য লিখেছি তাতে আমার নিজের কোনোই সন্দেহ নেই। তবে এই প্রজন্মের অনেক পাঠক-পাঠিকা এই বইটি হয়তো আগ্রহ সহকারেই পড়বেন আশা করি।
সম্পাদক, কবি ও শিশুসাহিত্যিক। ২৮ শে ডিসেম্বর লক্ষীপুর জেলার, চন্দ্রগঞ্জ থানার অন্তগর্ত- হাজিরপাড়া ইউনিয়নে সম্ভ্রান্ত এক মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা : আবুল কাশেম। মাতা : হাছিনা বেগম। গ্রামেরই আলো-বাতাসে বেড়ে উঠেছেন তিনি। ছোটবেলা থেকেই ছিলেন সাহিত্যানুরাগী। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্যাবসা। বর্তমানে চট্টগ্রাম শহরেই ২০০৭ সাল থেকে নিজের ব্যাবসা-প্রতিষ্ঠানগুলো দেখাশোনা, চট্টগ্রামে মাসিক পত্রিকা ‘দৈনিক চট্টগ্রাম সমাচার’-এর সহযোগী সম্পাদক, ‘ইদানীং সাহিত্যচর্চা’ চট্টগ্রামকেন্দ্রের সহসভাপতি, হিলফুল ফুযুল সাহিত্য কানন - হিফুসাকা চট্টগ্রাম বিভাগীয় সমন্বয়কারী ও শিশুসাহিত্য সংগঠন ‘চাঁদের মেলা’র সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক এবং চট্টগ্রামের শীর্ষস্থানীয় প্রকাশনা অক্ষরবৃত্ত প্রকাশনের মুখপত্র সাহিত্যের ছোটকাগজ ‘অক্ষরবৃত্ত’র সহযোগী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। সাংবাদিকতা, সম্পাদনা, লেখালেখি ও সংগঠন-প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সৎ, নিষ্ঠাবান ও পরিশ্রমী। হাজারো কর্মব্যস্ততার মাঝেও তার প্রিয় পাঠকদের জন্য তার আবেগ ও ভালোবাসা দিয়ে লিখে যাচ্ছেন। ২০০৮ সালের অমর একুশে বইমেলায় তার প্রথম একক কাব্যগ্রন্থ ‘আকাশের কান্না’ প্রকাশিত হয়। তার প্রকাশিত আরো একক কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে- মেঘলা আকাশ, ঔজ্জ্বল্য আকাশ, ছড়ায় ছড়ায় স্বরবর্ণ, প্রিয় হাইকু, প্রিয় হাইকু-২। মুজিব মানে বাংলাদেশ, মনপ্রবাহ ও বিনীত প্রকৃতি বই তিনটির সম্পাদনাসহ পত্রপত্রিকা ও যৌথ কাব্যগ্রন্থে প্রচুর লেখা লিখেছেন তিনি।