কর্তার কীর্তি বর্ধমান জেলার ধনী ও বনিয়াদি জমিদার বাবু হৃষীকেশ রায় তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র হেমন্তকে বাড়ি হইতে দূর করিয়া দিয়াছিলেন। ইহার কারণ সে তাঁহার মনোনীতা পাত্রীকে উপেক্ষা করিয়া একটি আই-এ পাস করা মেয়েকে নিজে পছন্দ করিয়া বিবাহ করিয়াছিল। ভয় নাই, ইহা পিতৃরোষপীড়িত হেমন্তের দুর্দশার করুণ কাহিনী নয়। হেমন্তকে শেষ পর্যন্ত অর্থাভাবে স্ত্রী-পুত্রকে পথে বসাইয়া উদ্বন্ধনে প্রাণত্যাগ করিতে হয় নাই। বিবাহের পূর্বে সে কলিকাতার একটা বড় কলেজে অধ্যাপনার কাজ পাইয়াছিল; তাহা ছাড়া পরীক্ষার কাগজ দেখিয়া ও ঘরে বসিয়া শিক্ষকতা করিয়াও যথেষ্ট উপার্জন করিত। সুতরাং পিতা ত্যাজ্যপুত্র করিয়া ঘরের বাহির করিয়া দিলেও, অর্থের দিক দিয়া অন্তত তাহার কোনও ক্লেশ হয় নাই। হৃষীকেশবাবুর মতো বদ্রাগী অগ্নিশর্মা লোক আজকালকার দিনে বড়-একটা দেখা যায় না। পুরাকালে বদ-মেজাজী বলিয়া দুর্বাসা মুনির একটা অপবাদ ছিল বটে, কিন্তু তিনিও অকারণে অভিসম্পাত দিয়াছিলেন বলিয়া আমাদের জানা নাই। হৃষীকেশবাবুর কারণ-অকারণের বালাই ছিল না, তিনি সর্বদাই চটিয়া থাকিতেন। শুনা যায়, সতেরো বৎসর বয়সে তাঁহার একবার টাইফয়েড হয়, সারিয়া উঠিয়া তিনি তেঁতুলের অম্বল দিয়া ভাত খাইবার ইচ্ছা জ্ঞাপন করেন।
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় জন্মেছিলেন ১৮৯৯ সালের ৩০ মার্চ, ভারতের উত্তর প্রদেশের জৌনপুর শহরে। তাঁর আদিনিবাস উত্তর কলকাতার বরানগর কুঠিঘাট অঞ্চলে। লেখক হিসেবে তাঁর প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে ২০ বছর বয়সে, যখন তিনি কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজে আইন নিয়ে পড়াশোনা করছিলেন। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় উপন্যাস জগতে বাংলা সাহিত্যকে উপহার দিয়েছেন অমর গোয়েন্দা চরিত্র ব্যোমকেশ বক্সী, যা প্রথম আত্মপ্রকাশ করেছিল ১৯৩২ সালে 'সত্যান্বেষী' গল্পের মাধ্যমে। শুধু উপন্যাস বা গল্প সংকলন নয়, বাংলা সাহিত্যে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় কবিতাও কম রেখে যাননি। ২২টি কবিতার সংকলন নিয়ে প্রকাশিত 'যৌবন-স্মৃতি' ছিল তাঁর প্রকাশিত প্রথম বই। ১৯১৯ সালে তিনি বি. এ. পরীক্ষায় পাশ করে কলকাতা ছেড়ে সুদূর পাটনায় গিয়ে থাকতে শুরু করেন এবং সেখানেই আইন নিয়ে পড়াশোনা চালাতে থাকেন। আইন নিয়ে পড়াশোনা শেষ করে একদম পুরোপুরিভাবে গল্প ও উপন্যাস লেখায় ঝুঁকে পড়েন। ১৯৩৮ সালে পাটনা ছেড়ে মুম্বাই যান বলিউডে কিছু কাজের উদ্দেশ্যে এবং ১৯৫২ সালে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সাথে সমস্ত চুক্তি বাতিল করে মুম্বাই ছেড়ে পুনে চলে আসেন। সেখানে থাকাকালেই একের পর এক প্রকাশিত হতে থাকে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ যার বেশিরভাগই ছিল ভৌতিক, রোমান্টিক ও আধ্যাত্মিকতা সম্পর্কীয় গল্প। ব্যোমকেশ সমগ্র ছাড়াও 'গৌড়মল্লার', 'তুমি সন্ধ্যার মেঘ', 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' এর মতো দুর্দান্ত সব উপন্যাস আছে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের বই এর তালিকায়। শুধু বাংলা নাটক বা চলচ্চিত্র না, তাঁর লেখা ব্যোমকেশ বক্সী জায়গা করে নিয়েছিল হিন্দি টিভি সিরিজ ও হিন্দি চলচ্চিত্রেও। অর্জনের ঝুলিতে অনেক পুরষ্কারের মাঝে তাঁর রয়েছে রবীন্দ্র পুরষ্কার, যা তিনি পেয়েছিলেন 'তুঙ্গভদ্রার তীরে' উপন্যাসটি লিখে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পান শরৎ স্মৃতি পুরস্কার। ১৯৭০ সালের ২২ সেপ্টেম্বর এই লেখকের জীবনাবসান ঘটে।