সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ছোট গল্পের সম্ভারে বিষয়-বৈচিত্র্য ও স্থানিক বৈচিত্র্য সব সময়েই পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। কলকাতা আর মফস্সল তো থাকেই; তার সঙ্গে আছে আসাম, বাংলা-বিহার সীমান্ত, জঙ্গল অঞ্চল, বাংলাদেশ, আছে আমেরিকার নানান জায়গা। এই সব অঞ্চলের নানা স্তরের মানুষও ছড়িয়ে আছে তাঁর বিভিন্ন ছোট গল্পের নানা চরিত্রে। এইসব বিভিন্ন চরিত্রের যে বিচিত্র মানস-জগৎ সুনীল গঙ্গো- পাধ্যায়ের গল্পে পাওয়া যায়, তা কখনও পাঠকের মনকে ভারী করে তোলে, কখনও চমৎকৃত করে, কখনও বা কাব্যিক রূপকথার আবেষ্টনে পাঠকের মনকে উধাও করে এক অজানালোকে নিয়ে যায়। আবার কখনও কোন গল্পের স্মিত বুদ্ধিদীপ্ত কৌতুকে পাঠকের মন প্রসন্ন হয়ে ওঠে। সুনীলের লেখনী কথাসাহিত্য, কবিতা, রম্যরচনা সর্বক্ষেত্রেই সাবলীল। এই অনন্য- সাধারণ রমণীয়তায় তাঁর ছোটগল্পগুলি মণ্ডিত। এই রমণীয়তার সঙ্গে আছে সর্বস্তরের মানুষের প্রতি অপরিসীম সহানুভূতি ও ভালবাসা । দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসঞ্জাত জীবনবোধ ও সমাজচেতনা তাঁর ছোট গল্পের জগৎকে অনির্বচনীয়তার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। কখনও কল্পনার অমর্ত্যলোক, কখনও কঠিন বাস্তব- জগতের ধরাতল—এই দুই মেরুতে যাতায়াতে পাঠক ক্রমশ আবিষ্ট হয়ে পড়ে, অসীম পরিতৃপ্তির আস্বাদে পাঠকের মন আনন্দে ভরে ওঠে।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।