প্রাককথা ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির ইতিহাসের মহানায়ক, স্বাধীন বাঙালি জাতির পিতা ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এক অমর সৃষ্টি, বাঙালির মহাকাব্য। এ ভাষণ বিশ্বর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ হিসেবে সমাদৃত। ২০১৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা ইউনেস্কো কর্তৃক বঙ্গবন্ধুর এ ভাষণ বিশ্ব-ঐতিহ্য সম্পদ হিসেবে স্বীকৃত হয়ে “ইন্টারন্যাশনাল মেমােরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্টার’এ স্থান করে নেয়। ৭ই মার্চের ভাষণ এ পর্যন্ত ইংরেজি, হিন্দি, উর্দু, আরবি, রুশ, ফরাসি, চীনা, ইতালিয়, জাপানিজ, স্পেনীয়, ফার্সি, কোরিয়ানসহ আরও অনেক ভাষায় অনূদিত হয়েছে এবং হচ্ছে। ১৯৭১-এর ৭ই মার্চ থেকে বর্তমান পর্যন্ত এ ভাষণ বাংলা ভাষাসহ বিশ্বের কত কোটি মানুষ কত শতবার শুনেছে, তার কোনাে সীমা-পরিসংখ্যান কারও জানা নেই। এ ভাষণের একটি অসাধারণত্ব হলাে, যতবারই শােনা হয়, মনে হয় এই বুঝি প্রথমবার শােনা হলাে। বিখ্যাত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিন Newsweek (5 April 1971) এ ভাষণকে ‘কবিতা’র সঙ্গে তুলনা করে বঙ্গবন্ধুকে আখ্যায়িত করে ‘Poet of Politics হিসেবে। এর প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি বাক্যে রয়েছে অনুরণন। একটি ভাষণ থেকে একটি জাতি-রাষ্ট্রের সৃষ্টি পৃথিবীর ইতিহাসে এর নজির নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ সেটিই সম্ভব করেছে। বস্তুত ৭ই মার্চের ভাষণ থেকেই বাঙালির হাজার বছরের স্বতন্ত্র জাতিসত্তার গঠন আর জাতীয় মুক্তির দীর্ঘ আন্দোলন, সংগ্রাম ও স্বপ্নের ইতিহাস। এরপরও প্রশ্ন থেকে যাবে, বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণ বাঙালির জন্য, বিশ্বমানবতার জন্য কেন এত গুরুত্ব ও তাৎপর্যপূর্ণ ? এ থেকে আরও কী কী শিক্ষণীয় রয়েছে ?
অধ্যাপক ড. হারুন-অর-রশিদ (জন্ম: ২৭ অক্টোবর ১৯৫৪) জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক দুইবারের উপাচার্য (২০১৩-২০২১)। এর আগে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে সিলেকশান গ্রেডের একজন অধ্যাপক ও উপ-উপাচার্য (২০০৯-২০০১২) নিযুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি ‘বাংলাদেশ স্কাউটস, রোভার অঞ্চল’র সভাপতি হিসেবে দায়িত্বরত আছেন। জন্ম পিরোজপুর জেলার কাউখালী উপজেলার আইরন গ্রামে। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার বি.এ. (অনার্স) এবং মাস্টার্স ডিগ্রি লাভ করেন। পরে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ডব্লিউ এইচ মরিস-জোনস-এর তত্ত্বাবধানে ১৯৮৩ সালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে তাঁর পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন। একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে তিনি পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা সম্পন্ন করেন। এছাড়াও তিনি সুইডেনের উপসালা (শান্তি ও সংঘাতের উপর) ও জাপানের রিউকোকু (কিওটো) বিশ্ববিদ্যালয়ে পোস্ট-ডক্টরাল গবেষণা করেন। ১৯৪৭-পূর্ব ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনাধীন অবিভক্ত বাংলা, পাকিস্তানি শাসনকাল, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, সমসাময়িক ভারত ও বাংলাদেশের রাজনীতি, এর গতিধারা ও রাজনৈতিক উন্নয়ন’ তাঁর গবেষণার ক্ষেত্র। বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র গঠন সব সময় তাঁর গবেষণার কেন্দ্রীয় বিষয়। তাঁর গবেষণা-গ্রন্থের মধ্যে The Foreshadowing of Bangladesh 1906-1947 (fourth edition, UPL 2015), Inside Bengal Politics 1936-1947 : Unpublished Correspondence of Partition Leaders (second edition, UPL 2012), বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী পুনর্পাঠ (ইউপিএল ২০১৩), বাঙালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের . অভ্যুদয় (আগামী প্রকাশনী ২০০৩), বাংলাদেশ : রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০০০ (নিউ এজ পাবলিকেশন্স ২০০১), “আমাদের বাঁচার দাবী’ : ৬ দফার ৫০ বছর (বাংলা একাডেমি ২০১৬), মূলধারার রাজনীতি : বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল ১৯৪৯-২০১৬ (বাংলা একাডেমি ২০১৬), ৭ই মার্চের ভাষণ কেন বিশ্ব ঐতিহ্য-সম্পদ : বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশ, (বাংলা একাডেমি ও অন্যপ্রকাশ ২০১৮) বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। প্রফেসর হারুন-অর-রশিদ বর্তমানে বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটিতে ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের এনসাইক্লোপিডিয়া’ (২০ খণ্ড) রচনা প্রকল্পের প্রধান হিসেবে গবেষণাকর্মে নিয়োজিত। বঙ্গবন্ধুবিষয়ক গবেষণায় অবদান রাখার জন্য ২০২১ সালে তিনি বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে ভূষিত হন।