আমি ও আমার মুক্তিযু্দ্ধ গ্রন্থটি একজন শহীদের স্ত্রীর আত্নকথন। শহীদের স্ত্রী একজন নিভৃত চারিণী। ১৯৭১ এর ১৪ ডিসেম্বরের পরে ওর সঙ্গে বিভিন্ন সমিতিতে দেখা হয়। নভেম্বর ১৯৭২ ওর ডাক্তার স্বামীকে আল বদর আল শামস বাহিনী বাসা থেকে তুলে নিয়েছির। পরে লাশ পাওয়া গিয়েছেল ফকিরপুলের ডোবায়।তখন সে অন্তসত্তা। ওর ছেলের জন্ম হয় ১৯৭২ এর জানুয়ারিতে । খুব অল্প বয়সী এ শহীদের স্ত্রীকে দেখে আমার খুব কষ্ট হয়েছিল। কঠিন সংগ্রামের মুখোমুখি দাড়িয়ে তাকে দেখেছি- দেখেছি ওর কষ্ট আর যাতনা । নবজাতক শিশু সন্তান নিয়ে কখনও ভাই বা কখনো বোনের বাসায় আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বার বারই ওর মনে হয়েছে ওর যেন কারোও গলগ্রহ। ওর দুর্দশা আমাকে কষ্ট দিত । কখন তো আমারও বেঁচে থাকার যুদ্ধ। তবুও ও পাশে দাড়িয়েছিল গভীর মমত্ববোধে। লেখা পড়ার পাঠ না চুকতেই ওর বিয়ে হওয়ার কারনে সম্মান জনক কোন চাকরি করা ওর সম্ভব হয়নি। আমার শত ব্যস্ততার মাঝেও ওর কষ্ট আমাকে পীড়া দিত। সহায় সম্বলহীন একমাত্র শিশুকে নিয়ে ওর বিড়ম্বনা দেখেছি খুব কাছে থেকে। কী অসহায়। সহায় সম্বলহীন। কাছের মানুষগুলো যেন দূরে সরে গেল। এটিই জীবনের বাস্তব সত্য। আমি প্রাণের টানে ওকে কাছে টেনে নিয়েছি। একটি বাড়ি বহু কষ্টেও বরাদ্দ পেয়েও নিদারুন আর্থিক সংকটের মধ্যে ওর দিন কেটেছে। শিশু পুত্র সাক্ষীকে নিয়ে ওর অবিরাম সংগ্রাম। দীর্ঘ আটত্রিশ বছর ধরে ওর সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক। হতাশায় নিমজ্জিত এ শহীদের স্ত্রী সাক্ষীকেও উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করতে না পারার তীব্র বেদনা বোধে শহীদের স্ত্রী যন্ত্রণা কাতর হয়। স্বাধীন বাংলাদেশের পনের কোটি মানুষের মধ্যে নিজেকে আড়াল করে দীর্ঘ পথ চলার যন্ত্রণা ,ক্ষোভ ও কষ্টের সাগরে ভাসতে ভাসতে আজ এত বছর পর আমার দেখা এ শহীদের স্ত্রীর জীবনের কিছু কথা পাঠকের সামনে তুলে ধরলাম-শুধুই কেবল বিবেকের তাড়নায়। ওরই অনুরোধে শুধু কেবল গ্রন্থখানিতে পূর্ন নাম উল্লেখ করিনি। জানিনা এটা কতটা সুবিচার হয়েছে। নিভৃতচারিণী এ শহীদর স্ত্রী দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় যে কন্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে সে চায় তা নিভৃত-ই থাকুক। ওর কষ্ট ও যাতনার কতটা বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে পেরেছি জানিনা। দীর্ঘ বছর আমার সাথে গভীর সম্পর্কের মধ্যে ওর স্বামী হারানোর কষ্ট বহুর মাঝে একাকিত্ব থাক,কাছের মানুষের আশ্চার্য ব্যবহার সব মিলিয়েই আমরা দুজনই অভিন্ন্। এমন কাছের একজন শহীদের স্ত্রীকে দেখেছি ,কষ্টে যাতনার কথা যেভাবে বলেছে –এ গন্থে এভাবেই লিপিবদ্ধ হয়েছে। এমন নেপথ্যচারিণী সংগ্রামী মহিলার কথার মালায় সাজিয়েছি “আমি ও আমার মুক্তিযুদ্ধ” । ওর সাহভয্য-সহযোগিতা না পেলে এ গন্থ রচনা আমার জন্য কষ্ট সাধ্য হতো। দিনতো ফুরিয়ে যায়,অপূর্ণতাও থেকে যায় জীবনের নানা পরতে এ শহীদের স্ত্রী ছেলেকে সব অপূর্ণতার কথা বলতে পারছে না বলেই এ গন্থে অনেক না বলা কথা বেরিয়ে এসেছে। আমিও মহান শহীদের স্ত্রী কাছে কৃতজ্ঞ। আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন এ শহীদের স্ত্রী না বলা কথা গুলো লিখে নিজেকে ধন্য মনে করছি।
১৯৬৯-এর কোনাে এক সােনালি বিকেলে পান্না কায়সার প্রখ্যাত সাংবাদিক সাহিত্যিক শহীদুল্লা কায়সারের হাত ধরে বাসর সাজিয়েছিলেন । কিন্তু ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বর বিজয়ের মাত্র দুদিন আগে আলবদর, রাজাকার বাহিনী শহীদুল্লা কায়সারকে ধরে নিয়ে যায় । তিনি আর ফিরে আসেননি। শুরু হলাে পান্না কায়সারের জীবনযুদ্ধ। পেশা হিসেবে বেছে নিলেন অধ্যাপনা । শুধু অধ্যাপনাই নয়, পান্না কায়সার স্বামী শহীদুল্লা কায়সারের আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে সম্পৃক্ত হলেন বিভিন্ন সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সাথে । লেখালেখির জগতে পান্না কায়সারের প্রবেশ ১৯৯১-এ প্রথম গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধ আগে ও পরে বহুল আলােচিত ও প্রশংসিত । ১৯৯২-তে প্রকাশিত হয়েছে মুক্তি, নীলিমায় নীল, হৃদয়ে একাত্তর ও কাব্যগ্রন্থ বৃষ্টির শব্দ না এলে কান্না আসে না ।। তিনি রাশিয়া, আমেরিকা, লন্ডন, সুইডেন, জেনেভা, প্যারিস, ইরাক, থাইল্যান্ড, মধ্যপ্রাচ্য, অস্ট্রেলিয়া ও পূর্ব জার্মানিসহ বহু দেশ ভ্রমণ করেছেন। ব্যক্তিগত জীবনে পান্না কায়সার সদালাপী, বিনয়ী, ভদ্র ও নম্র। বন্ধুদের সাথে গল্প করতে ভালােবাসেন। অবসর সময় গান শুনে আনন্দ পান। বর্ষার সময় একাকী বারান্দায় বসে লিখতে ভালােবাসেন। দেশভ্রমণ লেখিকার অন্যতম শখ ।