গোরার প্রেক্ষাপট বিশাল। এতে উপস্থাপিত হয়েছে শিক্ষিত বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজের চিন্তাচেতনায় উত্থিত উনিশ শতকের শেষার্ধের সমস্তু সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মতাদর্শ, সকল বিক্ষোভ ও আন্দোলন, ধর্মসংকট, জাতীয় জীবনের মুক্তি ও নতুন আদর্শ সন্ধানের চিন্তাধারা, যুক্তিতর্ক, একইসঙ্গে হৃদয়ানুভূতি, মানবসম্পর্ক, বুদ্ধিদীপ্ত বীর্যশক্তি ও মন্ময় হৃদয়ানুভূতি। অর্থাৎ একটি সংঘাতময় দেশ ও জাতির উচস্থানীয় শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী জীবনধারা। আধুনিক উপন্যাসের মূল লক্ষ্যই হলো ইতিহাসের পটে সমগ্র জনপদসম্পৃক্ত প্রতিনিধিস্থানীয় ব্যক্তিচরিত্রের মূল্যবোধগত সংকট, তা থেকে উত্তরণ। এই উত্তরণ নির্দ্বন্দ্ব থাকে না, তা spiral তথা কম্বুরেখ গতিবিশিষ্ট অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে পথ চলে। এবং ভিন্ন একটি মতাদর্শে উপনীত─হয় ইতিহাসেরই পটভূমিকায়। মনে রাখতে হবে গোরা চরিত্রটির জন্ম সিপাহি বিদ্রোহের সময়─১৮৫৭ সালে, কিন্তু রবীন্দ্রনাথ যখন উপন্যাসটি রচনা করেন তখনকার চিন্তাদর্শে ও ইতিহাস-সময়ে তাঁর অভিজ্ঞতায় ছিল ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের অভিজ্ঞতা। সমালোচকেরা এই রচনাটি সম্পর্কে দুটি মন্তব্য করেন, এক. এটি মহাকাব্যিক রচনা, দুই. এটি রবীন্দ্রনাথের আত্মজৈবনিক উপন্যাস, অর্থাৎ গোরার ফর্ম এপিকতুল্য এবং তা রবীন্দ্রনাথের নিজ চরিত্র বা জীবনের একটি বিচিত্র রূপ, কেননা লেখা মাত্রেই diversity of autobiography─সব লেখাই লেখকের বৈচিত্র্যময় আত্মজীবনীর রূপ-রূপান্তর। গোরার স্বাদেশিকতা ও বিশ্বজাগতিকতা আমাদের আজকের পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থাকে বুঝবার জন্য, স্ববিরোধকে চিহ্নিত ব্রার জন্য আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, ছোটগল্পকার, চিত্রশিল্পী, সংগীতস্রষ্টা, অভিনেতা, কন্ঠশিল্পী, কবি, সমাজ-সংস্কারক এবং দার্শনিক। গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য প্রথম বাঙালি হিসেবে ১৯১৩ সালে তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার লাভ করেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৬১ সালের ৭ মে তৎকালীন ব্রিটিশ-শাসিত ভারতে কলকাতার ধনাঢ্য ও সংস্কৃতিমনা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশব থেকেই তিনি লেখালেখিতে মনোনিবেশ করেন। ভানুসিংহ ঠাকুর ছিল তাঁর ছদ্মনাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই মানেই এক মোহের মাঝে আটকে যাওয়া, যে মোহ পাঠককে জীবনের নানা রঙের সাথে পরিচিত করিয়ে দেয় নানা ঢঙে, নানা ছন্দে, নানা সুর ও বর্ণে। তাঁর ৫২টি কাব্যগ্রন্থ, ৩৮টি নাট্যগ্রন্থ, ১৩টি উপন্যাস, ৩৬টি প্রবন্ধ ও অন্যান্য গদ্যসংকলন জীবদ্দশায় বা মৃত্যুর কিছুদিন পরই আলোর মুখ দেখে। কাবুলিওয়ালা, হৈমন্তী, পোস্টমাস্টারসহ মোট ৯৫টি গল্প স্থান পেয়েছে তাঁর ‘গল্পগুচ্ছ’ গ্রন্থে। অন্যদিকে ‘গীতবিতান’ গ্রন্থে সংকলিত হয়েছে ১,৯১৫টি গান। উপন্যাস, কবিতা, সঙ্গীত, ছোটগল্প, গীতিনাট্য, প্রবন্ধ, ভ্রমণকাহিনীসহ সাহিত্যের সকল শাখাই যেন ধারণ করে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমূহ। তিনি একাধারে নাট্যকার ও নাট্যাভিনেতা দুই-ই ছিলেন। কোনো প্রথাগত শিক্ষা ছাড়া তিনি চিত্রাংকনও করতেন। তৎকালীন সমাজ-সংস্কারেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন এই গুণী ব্যক্তিত্ব। বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাতেই অনূদিত হয়েছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর বই সমগ্র। তাঁর যাবতীয় রচনা ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’ নামে ত্রিশ খণ্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর বাড়িতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুর পর এতদিন পেরিয়ে গেলেও তাঁর সাহিত্যকর্ম আজও স্বমহিমায় ভাস্বর। আজও আমাদের বাঙালি জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে বিশ্বকবির সাহিত্যকর্ম।