আয়া সুফিয়া : গির্জা থেকে মসজিদে রূপান্তরকরণের বৈধতা। তুর্কি প্রজাতন্ত্রের দাবি অনুযায়ী, উসমানি খিলাফতের একটি অপ্রকাশিত পুরনো নথিপত্র বলে যে, ১৪৫৩ সালে উসমানি সুলতান মুহাম্মাদ আল-ফাতিহ কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর যাজকদের কাছ থেকে আয়া সুফিয়া গির্জা ও তৎপার্শ্ববর্তী এলাকার ভূমি নিজের পকেটের টাকার বিনময়ে খরিদ করে নিয়েছেন। এরপর আয়া সুফিয়া গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছেন। সে হিসেবে আয়া সুফিয়া মুসলমানদের নিজস্ব সম্পত্তি। জবরদখলকৃত নয় মোটেও। উপর্যুক্ত কথাটা খুবই চাউর হয়ে আছে গোটা মুসলিম বিশ্ব জুড়ে। আয়া সুফিয়াকে গির্জা থেকে মসজিদে রূপান্তরিত করায় যারা মুসলিমবিদ্বেষ উগড়ে যাচ্ছে, তাদের মোকাবেলায় উপরোক্ত কথাটা দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পত্রিকা থেকে নিয়ে মুসলিম স্কলারদের টুইটার ও ফেসবুক একাউন্টে পর্যন্ত। অথচ, উপরোক্ত দাবি ঐতিহাসিক সূত্রমতে এবং যুক্তির মানদণ্ডে উত্তীর্ণ নয়। দুইদিকই উল্লেখ করছি আমি- এক. আহমদ বিন ইউসুফ কিরমানি ছিলেন একজন নামকরা উসমানি ঐতিহাসিক। তিনি সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের সমকালীন ছিলেন। তিনি বলেন, সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ আয়া সুফিয়া গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন; তবে খ্রিষ্টান যাজকদের কাছ থেকে এটি খরিদ করেননি। আর মসজিদে রূপান্তরকরণ হয়েছিল মোট তিনদিনের ব্যাপ্তিতে। কেননা, কনস্টান্টিনোপলে সুলতান বিজয়ীবেশে প্রবেশ করেছিলেন মঙ্গলবার। পরের শুক্রবার সেখানে প্রথম জুমার নামাজ আদায় করার মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে তা মসজিদে রূপান্তর করেন। খ্রিষ্টান ঐতিহাসিক রোন্সম্যান স্টিভেন বলেন, কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ যাজকদের সাথে এমন সদয় আচর করেন, যা কল্পনা করাও মুশকিল ছিল! শহরে প্রবেশ করার পরপরই তিনি আয়া সুফিয়া গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করার ফরমান জারি করেন। পাশাপাশি তিনি এটির নামকরণ করেন- বড় জামে মসজিদ। শুধু আয়া সুফিয়াই নয়; সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ কনস্টান্টিনোপলের আরও অনেক গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। যেমন প্রসিদ্ধ তুর্কি ঐতিহাসিক মুহাম্মদ ফরিদ বেগ বলেন, সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ কনস্টান্টিনোপলের অর্ধেক গির্জা মসজিদে রূপান্তরিত করেন। আরেকজন তুর্কি ঐতিহাসিক ইসমাইল সিরহিন্ত বলেন, সুলতান মোট ৪ টি গির্জা মসজিদে রূপান্তরিত করেন। পক্ষান্তরে আমেরিকান ঐতিহাসিক স্টানফোর্ড শো বলেন, সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ কনস্টান্টিনোপলের ১৭ টি গির্জা মসজিদে রূপান্তরিত করেন। দুই. কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের আগ পর্যন্ত উসমানি সাম্রাজ্য ছিল অনেকটা দুর্বল। সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের নিজস্ব মালিকানাধীন সম্পত্তি বা সাম্রাজ্যের কোষাগার এমন পর্যায়ের ছিল না যে, তা দ্বারা বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের এই ঐতিহ্যবাহী গির্জা খরিদ করবেন। তা ছাড়া গির্জাটি যাজকদের ব্যক্তিগত কোনো সম্পদ ছিল না; এটি ছিল গোটা অর্থোডক্স খ্রিষ্টজগতের সম্পত্তি। উপরোক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে যে, আয়া সুফিয়া গির্জা যাজকদের কাছ থেকে খরিদ করেননি সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ; বরং কনস্টান্টিনোপল জয় করার পর তিনি এটিকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। যেমনটি তিনি কনস্টান্টিনোপলের আরও অন্যান্য গির্জার বেলায় করেছেন। তাহলে সুলতানের এই কাজটা কি শরিয়তসম্মত নয়? ইসলাম কি এরকম গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরকরণ সমর্থন করে? হ্যাঁ, সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের এই রূপান্তরকরণ সম্পূর্ণ শরিয়ত সমর্থিত। তাঁর এই মহান কাজ শুধু ইসলাম সমর্থনই করে না; বরং এটি মক্কাবিজেতা মুহাম্মাদুর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এক যুগান্তকারী সুন্নাহর অনুসরণ। অমুসলিমদের কব্জা থেকে বিজিত অঞ্চলে মুসলমানদের করণীয় পদক্ষেপ ও ধর্মীয় কর্মপন্থাসমূহের মধ্য থেকে এটি একটি অন্যতম কর্ম। সামনের আলোচনা থেকে এটাই ফুটে উঠবে, ইনশাআল্লাহ। কনস্টান্টিনোপল বিজয়ের পর আয়া সুফিয়া গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরকরণের কাজটি সম্পন্ন হয়েছিল তৎকালীন উসমানি সাম্রাজ্যের নামকরা আলিম, প্রসিদ্ধ বুজুর্গ আল্লামা শামসুদ্দিন বিন হামজাহ, উরফে শাইখ আক শামসুদ্দিনের ফতোয়ার আলোকে। তিনি সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহের উস্তাদ ছিলেন এবং তাঁকে কনস্টান্টিনোপলের আধ্যাত্মিক বিজয়ী হিসেবে গণ্য করা হয়। শাইখ আক শামসুদ্দিনকে নিয়ে অতীতে আমি অনেক আর্টিকেল লিখেছি। আমার বই- উসমানি খেলাফতের স্বর্ণকণিকাতেও পড়তে পারেন। সমকালীন বিশ্বের প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ড. রাগিব সারজানি বলেন, অমুসলিমদের যেসব অঞ্চল সন্ধির মাধ্যমে জয় করা হয় এবং যেসব অঞ্চল যুদ্ধের মাধ্যমে জয় করা হয়, এগুলোর মধ্যে ইসলাম ব্যবধান সাব্যস্ত করেছে। অমুসলিমদের যেসব অঞ্চল সন্ধির মাধ্যমে বিজিত হয়, সেগুলোর উপাসনালয় মসজিদে রূপান্তর করা যাবে না। বরং সেগুলোর হুকুম উভয় পক্ষের কৃত চুক্তি অনুযায়ী হবে। যেমন ফিলিস্তিনের আল-কুদস। এটি বিজয় করার পর খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব রা. এটির 'কিয়ামাহ' নামক গির্জা কিংবা অন্য কোনো গির্জা মসজিদে রূপান্তর করেননি। কিন্তু যেসব অঞ্চল যুদ্ধের মাধ্যমে বিজিত হবে, সেগুলোর সবকিছুর মালিক হয়ে যাবে মুসলিমরা। আর মালিকানাধীন বস্তুসমূহের মধ্য থেকে গির্জাও একটি। চাইলে মুসলিম শাসক গির্জাগুলোকে মসজিদে রূপান্তরিত করতে পারেন, না চাইলে নাই। যেমন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের কনস্টান্টিনোপল। এটি বিজয় করার পর সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ এটির মালিক হয়ে যান এবং আয়া সুফিয়া গির্জাসহ শহরের অন্যান্য গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেন। তদুপরি কনস্টান্টিনোপল শহর অবরোধ করার পর সুলতান বাইজেন্টাইন সম্রাটকে বিনা যুদ্ধে শহর হস্তান্তর করার আদেশ দেন। কিন্তু সম্রাটের হঠকারিতার কারণে তিনি যুদ্ধের মাধ্যমে কনস্টান্টিনোপল শহর জয় করে তার মালিকানা প্রয়োগ করেন। নবি মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর ইমান আনয়নকারী প্রত্যেক মুসলমানকে জানতে হবে যে, মক্কার কাবাঘরে লাত, মানাত, উজ্জা, হুবলসহ ৩৬০ টি মূর্তি রক্ষিত ছিল। কাবাঘরই ছিল গোটা আরবের পৌত্তলিকদের সবচেয়ে বড় উপাসনালয়। কিন্তু অষ্টম হিজরিতে মক্কা বিজয়ের দিন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম কাবাঘরের সবগুলো মূর্তি ভেঙে, পৌত্তলিকদের উপাসনালয় এই কাবাঘরকে 'বাইতুল্লাহ' তথা আল্লাহর ঘরে রূপান্তরিত করেন। আজ গোটা মুসলিম উম্মাহর কাছে এটিই সবচেয়ে বড় ও মহান মসজিদ। সুতরাং, সুলতান মুহাম্মদ আল-ফাতিহ কর্তৃক আয়া সুফিয়া গির্জাকে মসজিদে রূপান্তরকরণ ছিল সম্পূর্ণ শরিয়তসম্মত। ইসলাম সমর্থিত। রাসুলের সুন্নাহর নির্দেশিত। এরপরও কোনো নামধারী মুসলিম যদি এই রূপান্তরকরণে অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে, বুঝতে হবে- এর অন্তরে ইমানের কোনো ছিটেফোঁটাও নেই; এ একজন আস্ত মুরতাদ! __________ সূত্রাবলি : (১) আখবারুদ দুওয়াল ওয়া আসারুল উয়াল ফিত তারিখ : ৩/৩১, আহমদ বিন ইউসুফ করমানি। (২) সুকুতুল কুসতিনতিনিয়্যাহ : ৪৯, রোন্সম্যান স্টিভেন। (৩) তারিখু দাওলাতিল আলিয়্যাতিল উসমানিয়্যাহ : ১৬৫, মুহাম্মদ ফরিদ বেগ। (৪) কিসসাতুল আন্দালুস; মিনাল ফাতহ ইলাস সুকুত : ৫৬৬-৫৬৯, ড. রাগিব সারজানি। (৫) তারিখুদ দাওলাতিল উসমানিয়্যাহ : ১/১৪০, ইলমাজ অজতোনা
জামেয়া তাওয়াক্কুলিয়া রেঙা, সিলেট এবং দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে অত্যন্ত কৃতিত্ব্বের সাথে দাওরায়ে হাদিস সম্পন্ন করেছেন। পাশাপাশি আল-হাইআতুল উলিয়া লিল জামিআতিল কাওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে প্রথমবার অনুষ্ঠিত দাওরায়ে হাদিস তথা সমমান মাস্টার্স এর পরীক্ষায় সম্মিলিত মেধাতালিকায় ২৮ নং স্থান অর্জন করেছেন। এ ছাড়াও আল-জামিআতুল আহলিয়া দারুল উলুম মুইনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রামের উচ্চতর হাদিস গবেষণা বিভাগে অধ্যয়ন করেছেন। বর্তমানে তিনি জামিআ ফারুকিয়া কওমিয়া সোনারগাঁ, নারায়ণগঞ্জে শাইখুল হাদিস হিসেবে অধ্যাপনা করছেন।