"জয় বাংলার লোক" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ মার্চ মাসের মাঝামাঝি ১৯৭১, আকাশে প্রায়ই কুন্ডলিত ধোঁয়ার আস্তরণ। অর্থাৎ শহর, নগর আর গ্রাম মিলিটারিরা জ্বালিয়ে দিচ্ছিল। সে এক অভাবনীয় আতঙ্ককাল পার করেছে সাধারণ মানুষ। কখন না জানি কী হয়! মাঝে মাঝে ভাবি, শিশুকালে এমন আতঙ্ককাল না দেখলেই কি হতাে না! আবার ফিরে মনে হয়, ক’জনেরই বা এমন ভাগ্য হয় জন্মভূমির স্বাধীনতার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার! একদিকে আতঙ্ক, আরদিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দু’চোখ জুড়ে! সে সময়ে রেডিওতে “এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম...” “আর যদি একটা গুলি চলে... তােমাদের কাছে আমার অনুরােধ রইলাে...” “ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলাে” মুহুর্মুহু করতালির মাঝে শেখ মুজিবের দৃঢ় আহ্বান আমরা খুব মনােযােগ দিয়ে শুনতাম। ছােট ছােট ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে তখন এই ভাষণ। তাদের মনেও এই আহ্বান গেঁথে গিয়েছিল। সে সময়ের কথা মনে হলে এখনও কেমন ঘাের লেগে যায়! সে এক ইতিহাস মানি। কিন্তু আর সব ইতিহাসের মতাে নয়। এ তাে জীবন্ত ইতিহাস! কোনদিন জীবন থেকে মুছে যাবে না। গেঁথে আছে... থাকবে জীবনের সবটা জুড়েই। সমস্ত জীবন জুড়ে ধারণ করে আছি একটি বলয়ে থমকে পড়া ইতিহাসের সেই কৃষ্ণ পক্ষটিকে... স্বাধীনতার গন্ধ-বর্ণ-ছন্দসুর; কখনাে বা বেদনায় মথিত হয়েছে হৃদয়ের তলদেশ... কেঁপে উঠি আজও ভয়ানক আতঙ্কে। সেই বেদনাবিধুর স্মৃতিরঙা দিনগুলােকে অক্ষরে না সাজালে হারাবে নিশ্চিত। সে চিন্তা থেকে কলম ধরেছি অন্তত আমার অনুভূতিতে স্বাধীনতাকে ধরে রাখবাে বলে। মুক্তিযুদ্ধকালীন যেসব ঘটনা প্রবাহ ছায়াছবির মতন চোখের সামনে ভেসে উঠেছে সেগুলাের বর্ণনায় কোথাও কোথাও অসঙ্গতি থাকতে পারে এবং অসংলগ্ন মনে হতে পারে। কেননা কৈশােরের স্মৃতিগুলাে স্পষ্ট ও গােছালাে নয়। তাই সেটুকু আমলে না নেয়ার জন্য পাঠকের কাছে অনুরােধ রাখছি। সুলেখক নই আমি; উপস্থাপনার বিচারে কতােটা সাহিত্য হয়েছে বা মােটে হয়ওনি। তবু শৈশবের স্মৃতিতে ধরে রাখি সেই মাহেন্দ্রক্ষণ... মহান লগ্নটুকু। মহাকাশের অযুত-নিযুত গ্রহ-তারকার মাঝে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মাটির পৃথিবী; তারই এক নিভৃত প্রান্তে সভ্যতার অগ্রাভিযানের আকাঙ্খা মিটাবার জন্য মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ বুকে ধারণ করেছিল বীর বাঙালি। সাম্রাজ্যবাদী দানবীয় শক্তিকে পরাহত করতে জনসাধারণ বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছিল সেদিন। মুজিব শতবর্ষে হাজারাে আয়ােজনের ভিড়ে আমার এ ক্ষুদ্র নিবেদন 'জয় বাংলার লােক' বইটি প্রকাশের ব্যাপারে যাঁরা পাশে থেকে সর্বতােভাবে সহায়তা দিয়েছেন এবং আমি যাঁদের কাছ থেকে সহযােগিতা নিয়েছি তাঁদের সবার কাছে আমি কৃতজ্ঞ।