সমসাময়িক কালের সমাজ, মানুষ, পরিবেশ ও প্রকৃতির সাথে একজন লেখকের সম্পর্ক গভীর। সৃজনের নেশায় চলমান জীবনে তিনি শেকড় সন্ধানী শিল্পে নিজেকে আবিষ্কার করেন। সমগ্রতার সন্ধান সেখানে আরও অন্তরঙ্গ। ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের উপর দাঁড়িয়েই আমাদের সাহিত্য রূপবান হয়েছে। মূল্যবােধের বৈশিষ্ট্য জীবনার্থবােধের সামগ্রিকতায় কখনাে বিপন্ন কখনাে আবার উজ্জ্বল আলােয় তা আগামী সভ্যতায় স্বপ্ন বুনে দেয়। চারপাশের মানুষগুলাের নানা অসহায়ত্ব স্বীকার করেই শিল্পী তার শিল্পের আশা নিয়ে বেঁচে থাকে। সে আশায় রূপা বলে ছিলাে-“আমি বিভ্রান্ত, আমি বিপন্ন- শুধু একটা সুখের নীড় চেয়েছিলাম। সকালে গানের সুরে বাড়িতে সবার ঘুম ভাঙ্গিয়েছি।” কখনাে স্বাতী ডিমেনশিয়ার শিকার হয়ে মস্তিস্কের স্মৃতি হারিয়ে বেগুনি রঙের শাড়ি জড়িয়ে বলে যায়, ‘বেলা যে পড়ে এলাে জলকে চল।' রূপকথার মা কন্যাকে বুকে জড়িয়ে বলে, এত বড় কবে হলিরে বুড়ি আমার। বৃদ্ধাশ্রমে জীবনের শেষ সাঁকোর কাছে এসে প্রিয়তমা মৃত স্বামীকে স্মরণ করে বলে যায়, “বড় ভালবাসি তােমাকে। তুমি মুক্ত। আমি মুক্ত, আজ আমরা খন্ডিত মৃত্যুর মত।” রেশমী দীর্ঘ দশ বছর পর আজ মা হয়েছে। চোখের জল মুছে। রেশমী বলে যায়, ও আমার করনাজয়ী ঘুঙুর বালা। মেয়ে তুমি আমার আকাশচুম্বী ধরিত্রী, তুমি তৃণমূলে বহুরূপী, তুমি শিল্পিত নৃত্যধারা।” -এভাবেই ছড়িয়ে আছে মুক্তির হাওয়া-অভ্যাসে, প্রেমে, বেদনায় অমরতা দেবে বলে। আমার গল্পগ্রন্থ ‘টান’-কিছুক্ষণের জন্য হলেও আপনার মননচেতনায় হিরকের মতাে জ্যোস্না পড়বে-জয়ী হবে মুগ্ধ মানবপ্রীতি।
কথা সাহিত্যিক ড. নাসরীন জেবিন। জন্ম নারায়ণগঞ্জে। পিতা-প্রয়াত হাবিবুর রহমান। মাতা-সাকিনা রহমান। দু’জনই শিক্ষকতার সাথে যুক্ত ছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা সাহিত্যে ডিগ্রিধারী বাবা ছিলেন লেখক। তাঁর আদর্শেই কণ্যার বেড়ে ওঠা এবং সাহিত্যের জগতে প্রবেশ। নাসরীন জেবিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছেন। পি.এইচ.ডি করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। পেশা-শিক্ষকতা, ঢাকা মহানগর মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক। পাঠককুলকে অনুপ্রানিত করেছে। তার সাহিত্যের নানামুখী বিস্তার আমাদের চিত্তাকাশে অসীমতার দ্যোতনা এনে দেয়। এদেশের মানুষ সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যকে ঘিরেই তার লেখার জগৎ উন্মোচিত হয়েছে। তার সৃষ্টির সম্ভারে যুক্ত হয়েছে উপন্যাস, প্রবন্ধ, কবিতা- যা বহু গবেষণা জার্নালে পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। সমকালের সমসাময়িক সমাজের দ্বন্ধ, সংঘাত, সংকটের সমগ্রতাবোধ, দ্রোহ উন্মোচিত হয়েছে তার সৃষ্টিতে। শুধু কথা সাহিত্যেই তিনি সমৃদ্ধ থাকেননি-নানা ব্যঞ্জনায় গদ্যের অবয়বে প্রবন্ধেও তা প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশিত গ্রন্থ ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোট গল্পে নিম্নবর্গ’, ‘বাংলা ছোটগল্প’, ‘নারী তুমি জয়িতা’, ‘ফিরে এসো সুতপা’, ‘নারীর পৃথিবী নারীর স্বপ্ন’, ‘দিঘিজল ছুঁয়ে যায় সর্বনাশা চিল’, ‘নারী তুমি অর্ধেক আকাশ’, ‘রবীন্দ্র বিচিত্রা’, ‘রূপন্তীর শেষ রাত’, ‘প্রতিবাদী নারী ও সমাজ’, ‘এক উঠোন আকাশ’, ‘অব্যক্ত’, ‘মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের জীবন ও উপন্যাস’, ‘বাংলাদেশের উপন্যাস’, ‘ঘাস ফড়িং’, ‘আমি তুমি ও সে’, ‘সাধের পালকে পূর্ণিমার চাঁদ’, ‘প্রজাপতি সুখ’, ‘মোহিনীর জন্য’, ‘টান’, ‘সেলিনা হোসেনের উপন্যাস ঐতিহ্য ও শিল্পরূপ।’ সাহিত্যে অবদানের জন্য নানা পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছেন। বিশাল বাংলা প্রকাশনি সাহিত্য পুরষ্কার-২০১৬, ২০১৭। সমরেশ বসু সাহিত্য পুরষ্কার-২০২০, রাহাত খান স্মৃতি পদক, বিশ্ব সাংস্কৃতিক কেন্দ্র সাহিত্য পুরষ্কার, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস সাহিত্য পুরষ্কার।