সাম্য আর উপমা তখন স্বাভাবিক প্রেমের বাঁধনে জড়িয়ে পড়েছিল। মাঝে-মাঝে রাতে ফোনে কথা হতো। দিনের বেলায় কলেজে দেখা হতো। কথা হতো খুবই সামান্য। ফোনে বা আড়ালে-একান্তে সাম্যকে 'তুমি' করে বললেও, সকলের সামনে ওকে 'আপনি' করে সম্বোধন করত উপমা। এক রাতে উপমাই আদুরে গলায় বলল সাম্যকে, 'চলো না, কোথাও ঘুরে আসি।' ভারি অবাক হলো সাম্য। জিগ্যেস করল ও, 'তোমার কি সেই সুযোগ আছে, উপি?' উপমার কণ্ঠে আগ্রহ, 'সুযোগ করে নেব। কবে যাবে— বলো?' 'রোববারে আমার কোনো ক্লাস নেই। ওইদিন যাওয়া যায়। যেতে পারবে?' উপমার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস, 'হুম, পারব।' 'কীভাবে যাবে? বাসা থেকে কী বলে বেরুবে?' 'সেটা আমার চিন্তা। তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।' 'শোনো।' 'বলো।' 'কলেজ ড্রেস পরে আসতে পারবে না। কলেজ ড্রেস পরে আমার সাথে ঘুরলে অস্বস্তি লাগবে।' 'কলেজ ড্রেস পরে আসব না।' 'তুমি কোথায় থাকবে? আমি কোথায় থাকব?' 'তুমি সিএনজি রিজার্ভ করে কলেজ থেকে খানিকটা দক্ষিণে ওই মোড়টায় দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি কাটায়-কাটায় নটায় গাড়িতে উঠে বসব।' 'তোমার ভয় করছে না, উপি? ধরা পড়ে যেতে পারো।' 'আমি ভয় পাচ্ছি না। ধরা পড়লে— পড়ব। তুমি পাশে থাকলে আমার কোনো ভয় নেই।' রোববার দিন আটটার দিকে কর্ণিয়া বাসায় এসে উপমাকে ভারি অস্বস্তিতে ফেলে দিলো। কর্ণিয়াকে খুব জোরে থাপড়াতে ইচ্ছে করছে উপমার। ও এখন এলো কেন? ঝামেলা পাকাবে তো! কর্ণিয়াকে মিথ্যা কথা বলল ও, 'আমার প্রচণ্ড মাথাব্যথা। রাতে ঘুম হয়নি। তুই একাই কলেজে যা। আমি ঘুমুব।' কর্ণিয়াকে কোনোরকম খাতির না করে দ্রুত বিছানায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলো। কর্ণিয়া কিছুক্ষণ বোকার মতো বসে থেকে কলেজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো। কর্ণিয়া চলে যাবার পরপরই বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠল উপমা। নতুন একটা আকাশি রঙের জামা পরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে সাজগোজ শুরু করল। ছালেহা খুব অবাক হচ্ছিলেন। বিস্ময়ের সাথে জানতে চাইলেন উনি, 'উপি, কোথায় যাচ্ছিস তুই?' 'কলেজে যাব, মা।' 'তোর না মাথাব্যথা?' 'মাথাব্যথা করছিল। এখন করছে না।' মিথ্যা কথা বলতে একটুও বুক কাঁপছে না উপমার। বরং আনন্দ হচ্ছে। 'উপি, কলেজে যাবি ভালো কথা, তোর ইউনিফর্ম কই? এই ড্রেসে যাচ্ছিস কেন?' 'ড্রেস নোংরা হয়ে গেছে মা।' 'তোর তো দুটো ড্রেস।' 'দুটোই নোংরা হয়ে গেছে।' ছালেহা ড্রেস দুটি খুঁজে বের করলেন। সত্যিই নোংরা হয়ে আছে। সত্যি বলতে কি, উপমা ইচ্ছে করেই ড্রেস নোংরা করে রেখেছে। গতকাল রাতেই সে এটা করেছে। 'উপি, ইউনিফর্ম পরে না গেলে তো তোদের প্রিন্সিপাল গেট থেকে তোকে বার করে দেবে।' 'না মা। বের করে দেবে না। উনি আমাকে চেনেন ও ভালোবাসেন। ইউনিফর্ম ময়লা হয়ে গেছে বললে— ছেড়ে দেবেন। আমি তো সারাবছর ইউনিফর্ম পরেই কলেজে যাই।' মামণি আর কিছু বললেন না। উপমাকে সাজলে খুব সুন্দর দেখায়। ছালেহা মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মেয়ের দিকে। সাম্য একটা সিএনজি নিয়ে অপেক্ষা করছিল ওই মোড়টাতে। কাটায়-কাটায় নটায় উপমা এলো। দ্রুত সিনজিতে উঠল সে। সিএনজিতে উঠেই মাথার হিজাব খুলে ফেলল উপমা। চুলে খোঁপা আছে ওর। খোলা বাতাসে উড়তে লাগল সামনের কগাছা খোলা চুল৷ সিএনজি ড্রাইভারকে জিগ্যেস করল সাম্য,, 'আশেপাশে বেড়ানোর মতো ভালো জায়গা আছে?' সিএনজি ড্রাইভার দেখতে তরুণ। গায়ে মাংসের পর্যাপ্ত অভাব। গালে চর্বির ছিটেফোঁটাও নেই। গাল দুটো ভাঙা। দাড়ি-গোঁফ গজিয়েছে কি না— বুঝা যাচ্ছে না। পরনে ধূলিমলিন পোশাক। বলল সিএনজি চালক, 'একটা জায়গা আছে। যাইতে এখান থেকে ঘণ্টাখানেক সময় লাগব। নতুন পার্ক অইছে। মেলা মানুষ আহে।' সাম্য ড্রাইভারকে ওখানেই যেতে বলল। পার্কটিতে পৌঁছুতে-পৌঁছুতে সাড়ে দশটা বেজে গেল। এখন যথেষ্ট রোদ। রোদে যেন খা-খা করছে চারপাশ। উপমার হাতে আকাশি রঙের ছাতা। এই ছাতাটি সমাপ্তির। আজকের জন্য ধার নিয়েছে ও। ড্রেসের সাথে ছাতার রঙ মিলে যাওয়ায়— অন্যরকম সৌন্দর্য তৈরি হয়েছে। ছাতা মাথায় দিয়ে সিএনজি থেকে নামল উপমা। পঞ্চাশ টাকা করে টিকেট। পার্কের গেটটি বিশাল। মনোরম। দুপাশে পকেটের মতো টিকেট কাউন্টার। পার্কটি নতুন। পার্কের নাম 'গোলাপ কানন'। হরেকরকমের গোলাপ ফুলের চারা লাগানো হয়েছে এখানে। অন্যান্য ফুল গাছের চারাও আছে। ফুটেও আছে বিভিন্ন রঙের ফুল। এখানে-সেখানে বিভিন্ন প্রাণির পাথরের মূর্তি রয়েছে। পুরাতন জমিদার বাড়িও রয়েছে এখানে। জমিদারের নাম বিক্রমসিং পাল। পাশাপাশি দুটি প্রকাণ্ড প্রাসাদ। নতুন করে রঙ করা হয়েছে। ওরা জমিদার বাড়িটি ঘুরে-ঘুরে দেখল। পুরাতন নকাশা করা কাঠের ফার্নিচারগুলি সত্যি দৃষ্টিনন্দন। অসাধারণ লাগছে। দিনের এই সময়টাতে এখানে দর্শনার্থী অনেক কম। বিকেলের দিকে হয়তো দর্শনার্থী বাড়বে। এখানে বেশ কিছু ব্যতিক্রম রাইড আছে। যেমন— স্কাই ট্রেন, মেরি গো রাউন্ড, বাম্পার কার, বাম্পার বোট, ফেরিস হুইল, ওয়েভ পুল, কিডস পুল— ইত্যাদি। উপমাকে সাথে নিয়ে বেশ কয়েকটি রাইড উপভোগ করল সাম্য। উপমাকে খুব উচ্ছল দেখাচ্ছিল। খুকি-খুকি লাগছিল ওকে। একটি মনোরম ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে ফুচকা, চটপটি, কোল্ড-কফি খেল ওরা। মাটন-বিরিয়ানিও খেতে চেয়েছিল সাম্য। উপমার আপত্তিতে খায়নি। আবার বাইরে গিয়ে বেঞ্চিতে বসে গল্প করল ওরা। বেঞ্চিগুলো চমৎকার। প্রতিটি বেঞ্চির ওপর ছাতার মতো বাঁকানো ছাউনি আছে। বর্ষাকালে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এখানে বেড়াতে এলে— আরও ভালো লাগার কথা। বাগানের মালীর কাছে অনুমতি নিয়ে দুটো ফুটন্ত লাল গোলাপ তুলে আনল সাম্য। সাম্য হাসি-হাসি মুখে উপমাকে বলল, 'একটি গোলাপ তোমার মাথায় গুঁজো তো।' উপমা লজ্জায় ও ভালোলালাগায় যেন লতার মতো নুয়ে পড়ল। 'আমি কীভাবে গুঁজব? তুমি গুঁজে দাও।' সাম্যর বুক কাঁপছিল। কাঁপছিল হাতও। কাঁপা-কাঁপা হাতে উপমার চুলের খোঁপায় গুঁজে দিলো একটা লাল গোলাপ। উপমার চেহারা যেন বদলে গেল অনেক। একটা না-দেখা আভা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। রাগের ভঙ্গিতে বলল উপমা, 'এই, তুমি এভাবে থরথর করে কাঁপছ কেন?' সাম্য লজ্জা পেল খুব। দুপুর একটার দিকে ওরা 'গোলাপ কানন' পার্ক থেকে বের হলো। সিএনজিতে উঠে বসল ওরা। সাম্য বলার মতো কিছু খুঁজে না পেয়ে বলা শুরু করল পঙ্গপালের কথা। 'শোনো উপি, পৃথিবীর সামনে এখন ভয়াবহ বিপদ।' 'কী বিপদ?' 'পঙ্গপাল...' 'পঙ্গপাল কী?' 'পঙ্গপাল হচ্ছে এক ধরনের পোকা।' 'কেমন পোকা?' 'পোকাটা দেখতে অনেকটা ঘাসফড়িংয়ের মতো। এরা ঝাঁক বেঁধে ওড়ে। এক সাথে থাকে কোটি-কোটি পঙ্গপাল। এদের বংশবিস্তার হয় দ্রুত। কেনিয়া, উগান্ডা, আফ্রিকার দেশগুলোর ক্ষেতের পর ক্ষেত ফসল খেয়ে সাবাড় করে দিচ্ছে এই পোকাগুলি। এরোপ্লেন দিয়ে কীটনাশক ছিটিয়েও এদের নিধন করা যাচ্ছে না। কৃষকরা অসহায় বোধ করছে। সব ফসল খেয়ে শেষ করে ফেলছে। দুর্ভিক্ষ দেখা দিতে পারে। পঙ্গপালদের এখুনি আটকানো না গেলে— বিশ্বব্যাপী চল্লিশ লক্ষ লোক মারা যেতে পারে।' সাম্যর এই রসকষহীন সিরিয়াস টাইপের আলোচনায় রাগ উঠে গেল উপমার। রাগান্বিত গলায় বলল ও, 'তোমার কাছে এই পোকার গল্প কে শুনতে চেয়েছে? কথা খুঁজে না পেলে, চুপ করে বসে থাকো।' সাম্য চুপ করে রইল। মৃদু স্বরে উপমা বলল, 'তুমি হাত দুটো ওরকম প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখেছ কেন? হাত বের করো।' কিছু না বলে পকেট থেকে হাত দুটো বের করল সাম্য। উপমা এখন ওর চুলের খোঁপা খুলে ফেলেছে। চুল এলিয়ে দিয়েছে পিঠে। উড়ছে চুল। উড়ছে তো উড়ছেই। পাশাপাশি বসে থাকা সাম্যর কাঁধের ওপর, কখনো বা পিঠের ওপর, কখনো-সখনো মুখের ওপর গিয়ে পড়ছে চুল। সাম্যর কী যে ভালো লাগছে! জেগে-জেগেই স্বপ্ন দেখা শুরু করল সে। সাম্য জানেই না— কখন ওর বাঁ-হাতটা মুঠোবন্দি করে ফেলেছে উপমা। সাম্যের কাঁধের ওপর মাথা রেখে উপমা দিয়েছে ঘুম। বাচ্চা মেয়ের মতো নিশ্চিন্ত ঘুম। বাচ্চা মেয়ের মতো শান্তির ঘুম। উপমাকে আর ঘুম থেকে জাগাল না সে। যখন পথ ফুরিয়ে এলো, থেমে গেল সিএনজি, তখন উপমাকে ডেকে জাগিয়ে তুলল সাম্য। ঘুম থেকে জেগে খুব খারাপ লাগছে উপমার। এত তাড়াতাড়ি একটা দিন ফুরিয়ে গেল! নামার সময় উপমা খুব রাগ দেখাল, 'আমাকে এভাবে ঘুমুতে দিলে কেন? আমাকে আগেই জাগিয়ে তুললে না কেন? তোমার সাথে কত গল্প বলার ছিল। কত কথা বাকি থেকে গেল। আমার দিনটাই তুমি নষ্ট করে দিলে। ধ্যাৎ। কিছুই আর ভাল্লাগতাছে না।' বিকেল তিনটার আগেই আগেই বাসায় পৌঁছে গেল উপমা। খুব বেশি মিথ্যা কথা বলার আর প্রয়োজন পড়ল না ওর। এর ঠিক দিন কয়েক পর। সেদিন ভোর থেকেই গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্টি পড়ছিল। ছিল না বিদ্যুতও। প্রকৃতিতে তখন বসন্তকাল। ফাগুনের শেষ, চৈত্রের শুরু। আগের দিন বিকেল থেকেই আকাশে হালকা মেঘ ছিল। বৃষ্টি হবে-হবে ভাব ছিল। বাতাসও বইছিল বেশ। ভোরে লাল রঙের ছাতা ফুটিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছিল উপমা। পরনের জামাটাও ছিল আগুনের মতো লাল। তবে জামাটির মাঝেমাঝে বৃষ্টির ফোঁটার মতো গোলাকার— সাদা রঙের ডট আছে। ওড়নাটা সাদা রঙের। হিজাবও সাদা৷ মা ডেকে বললেন, 'এই বৃষ্টির মধ্যে কোথাও যেতে হবে না। বাসায়ই থাক। একদিন প্রাইভেট না পড়লে— কিছু হয় না।' উপমা মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে বলল, 'এই বৃষ্টিতে আমার কিচ্ছু হবে না। এরকম বৃষ্টিতে এর আগেও বহুবার গিয়েছি। গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস। স্যার সাজেশন দেবেন। শর্ট সাজেশন। আমি শুধু একা যাচ্ছি না। লিমা, হাসনা, জলি, শ্রাবনী, মিম, কর্ণিয়া— ওরাও যাচ্ছে। মেসেজ দিয়েছিল। ওরা না গেলে আমিও যেতাম না, মা।' কথাগুলো বলার পর কেমন জানি একটা পাপানুভূতি ঘিরে ধরল উপমাকে। মাকে মিথ্যে সে সহজে বলে না। ইদানীং বলছে। বলতে হচ্ছে তাকে৷ এভরিথিং ইজ ফেয়ার ইন লাভ অ্যান্ড ওয়ার— বলে একটি প্রবাদ তো আর এমনিতেই তৈরি হয়নি। গতকাল রাত থেকে সাম্যর সাথে সাক্ষাত করার জন্য উত্তেজনায় অস্থির হয়ে আছে উপমা। গতকাল বিকেলে কলেজ মাঠে ফুটবল খেলা চলছিল। ডিগ্রি শাখা বনাম অনার্স শাখা। রেফারির দায়িত্বে ছিলেন পরিতোষ স্যার। টানটান উত্তেজনা ছিল খেলাটিতে। দর্শকও ছিল প্রচুর। খেলার তখন তিন মিনিট বাকি। ডি-বক্সের ভেতরে ঢুকে গিয়েছিল অনার্স শাখার ফুটবলার জুয়েল। গোল পোস্ট বরাবর বাঁ পায়ের শট নিতে যাবে— ঠিক তখন ডিগ্রি শাখার এক ডিফেন্ডার, আরিফ, এসে পেছন থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো জুয়েলকে। রেফারি লম্বা করে ফুঁ দিলেন বাঁশিতে। ফাউল। হলুদ কার্ড। পেনাল্টি। পেনাল্টি ডিকলেয়ার করার পর হইচই শুরু হয়ে গেল দর্শক সারিতে। ডিগ্রি শাখার গ্যালারি থেকে পরিতোষ স্যারকে উদ্দেশ্য করে অকথ্য ভাষায় গালাগালি দেয়া হচ্ছিল। সবচে ভদ্র গালিটা হচ্ছে পরিতোষ স্যার একটা দালাল, মালাউন। কোনোরকমে খেলোয়াড়দের শান্ত করে পেনাল্টি শুটের আয়োজন করা হলো। এবং পেনাল্টিতে গোল। হইহই রইরই করে মাঠে ঢুকে গেল অনার্স শাখার শিক্ষার্থীরা। ডিগ্রি শাখার শিক্ষার্থীরা পেনাল্টি মেনে নেবে না। 'মানি না, মানি না। ভুয়া পেনাল্টি মানি না। মানব না।' এসব বলে স্লোগান দিচ্ছিল ওরা। মাঠেই খেলোয়াড়দের মধ্যে ধুন্ধুমার মারামারি লেগে গেল। কিছু বহিরাগত ছেলে এসে পরিতোষ স্যারের টি-শার্টের কলার ধরে ঘুষি মারা শুরু করল। পরিতোষ স্যার ভাষাহীন। দুঃখবোধে স্তব্ধ। দায়িত্বে থাকা শিক্ষকরা দৌড়ে পালাবার চেষ্টা করছেন। হাবিবুল স্যারের মোবাইল হারিয়ে গেল। তিনি 'হায়, আমার নতুন মোবাইল' বলে বিলাপ শুরু করলেন। বিজয় দত্ত স্যারের মানিব্যাগ উধাও। মানিব্যাগে ছিল ছত্রিশ টাকা। তবুও তিনি বিলাপ করছিলেন। দু বছরের পুরোনো মানিব্যাগটা তিনি কিনেছিলেন চারশো ষাট টাকা দিয়ে। এত দামি মানিব্যাগ! জীবনের চেয়ে যেন মানিব্যাগের দাম বেশি। সাম্য না পালিয়ে— চলে এলো মাঠে। চিৎকার করে বলল, 'থামো তোমরা। স্টপ অ্যাটাকিং ইচ-আদার। ইটস নাথিং বাট অ্যা গেইম। হোয়াই আর ইউ ফাইটিং? ইউ অল শুড বি রিয়্যালিস্টিক। খেলা খেলাই। খেলা নিছক বিনোদন মাত্র।' কে শোনে কার কথা? ইতোমধ্যে ইট-পাটকেল ছোড়াছুড়ি শুরু হয়ে গেছে। পরিতোষ স্যারকে রক্ষা করতে গিয়ে আক্রান্ত হলেন সাম্য স্যার। সবার প্রিয় সাম্য স্যার৷ মাথার পেছন দিকে এসে লাগল একটি ইটের টুকরো। রক্ত বেরুচ্ছে। কিছু ছাত্র— রাব্বি, হাসান, নাজমুল, অয়ন, গোপাল— ওরা এগিয়ে এসে ঘিরে ধরল সাম্য ও পরিতোষ স্যারকে। কেউ একজন বলল, 'স্যারদেরকে এক্ষুনি হাসপাতালে নিতে হবে। কুইক।' রণক্ষত্রে পরিণত হওয়া মাঠটিতে পড়ে রইল বেশ কিছু ইট-পাটকেলের টুকরো। হতাহত হলো প্রায় কুড়িজন। রাত নটার দিকে এসব জানতে পেরেছিল উপমা। সাম্যকে ফোন করেও পায়নি সে। বন্ধ ছিল। সাম্যর মোবাইলে চার্জ ছিল না। এগারোটার দিকে ফোনে পেয়েছিল সে। ধরা গলায় জানতে চেয়েছিল, 'খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার?' সাম্যর হয়তো সত্যি কষ্ট হচ্ছিল। এপাশ থেকে সাম্যর কণ্ঠটা জড়ানো-জড়ানো লাগছিল। 'না উপি। আমি ঠিক আছি।' 'সেলাই লেগেছে?' 'হুম৷ দুটো।' 'ওষুধ খেয়েছ?' 'হুম। খেয়েছি।' 'তুমি কি এখন হসপিটালে ভর্তি?' 'না। ছেড়ে দিয়েছে। মাথার পেছন দিকে ছোটো একটা ব্যান্ডেজ করে ছেড়ে দিয়েছে। তিনদিন পর আবার যেতে হবে। ড্রেসিং করতে হবে৷ এন্টিবায়োটিক দিয়েছে সাত দিনের।' 'ওষুধ মিস করবে না কিন্তু।' ভিন্ন প্রসঙ্গে চলে গেল সাম্য। 'খুব ঘুমোতে ইচ্ছে করছে, উপি।' 'ঘুমাও।' 'ঘুম আসছে না।' আবেগ মেশানো গলায় বলল উপমা, 'দুশ্চিন্তা কোরো না, প্লিজ। সব ঠিক হয়ে যাবে।' 'হয়তো হবে।' কিছুক্ষণ কী যেন ভাবল সাম্য। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকার পর বলল ও, 'কাল সকালে আমার সাথে দেখা করতে পারবে তুমি? খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।' কান্না চলে এলো উপমার। চোখের জল মুছে নিয়ে বলল সে, 'অবশ্যই আসব। অবশ্যই৷ তুমি এখন ঘুমাও তো।' রাতে আর ঘুমোতে পারেনি সাম্য। ঘুমোতে পারেনি উপমাও। সাম্য জানে উপমার কাছে মোবাইল থাকে না। কতবার ইচ্ছে করেছে, একটু ফোন করে উপমাকে বলে, 'উপি কথা বলো, কথা বলো, কথা বলো৷ তোমার কণ্ঠস্বর এত সুন্দর কেন? পাখির ডাকের মতো মিষ্টি লাগে কেন?' অথচ, উপমার কাছেই ফোনটা ছিল। সাম্য ফোন করতে পারে, এই ভেবে ফোনটা কৌশলে নিজের কাছে রেখে দিয়েছিল ও। সাম্যকে বারবার ফোন দেবার কথা ভেবেছে উপমাও। সাম্যর ঘুমে ব্যাঘাত ঘটবে— এই ভেবে ফোন দেয়নি সে। মানুষ কত অসহায়! মানুষ কেন পড়তে পারে না— মানুষের মনের ভাষা? সামান্য গুঁড়ি-গুঁড়ি বৃষ্ট কি উপমাকে ফেরাতে পারবে সাম্যর কাছে যাওয়া থেকে? ঘূর্ণিঝড়ও তো ফেরাতে পারবে না ওকে। বৃষ্টির গতি তখন আরও বেড়েছে। আকাশ মেঘে-মেঘে অন্ধকার রাতের নিকষ কালো। সাম্য শুয়ে-শুয়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের 'সেই সময়' পড়ছিল। হঠাৎ দরোজায় টাক-টাক শব্দ। এমন সময় কে আসবে? কোনোরকমে বিছানা থেকে উঠে দরোজাটা খুলে দিলো সাম্য। খুলেই দেখতে পেল উপমাকে। বুকটা ধক করে উঠল সাম্যর৷ উপমাটা পাগল নাকি? এমন ঝোড়ো আবহাওয়ায় কেন এসেছে? গতকাল ওকে দেখতে আসার কথা বলাটা ঠিক হয়নি। উপমা সাম্যকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে ঢুকল। সাম্যর বিছানাটা অগোছালো। মাথার কাছে অনেকগুলি মোটা-মোটা বই। বেশিরভাগ ইংরেজি নভেল, ড্রামা, হিস্ট্রি। শেকসপিয়রের 'হ্যামলেট', 'ওথেলো', 'ম্যাকবেথ', 'কিং লেয়ার', 'এজ ইউ লাইক ইট'— চোখে পড়ছে। সারাক্ষণ বই পড়ে কি না কে জানে। বিছানায় আধশোয়া হয়ে বসল সাম্য। পিঠের নিচে দুটো বালিশ। পরনে কালচে-কফি রঙের থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট। গায়ে ফুল হাতা সাদা রঙের গেঞ্জি। গেঞ্জিতে নেভি-ব্লু রঙে বড়ো করে ইংরেজিতে লেখা 'আই লাভ মাইসেলফ'। 'আই লাভ ইউ' না লিখে, 'আই লাভ মাইসেলফ' লেখার রহস্য কী— উপমার মাথায় ঢুকল না। কথা তুলল উপমা, 'কেমন লাগছে এখন?' সাম্যর কন্ঠস্বরটা এখনো জড়ানো। 'জ্বর আছে মনে হয়। ব্যথাও আছে। তীব্র ব্যথা ছিল রাতে।' অনুমতি না নিয়েই উপমা সাম্যর কপালে হাত রাখল। সত্যিই জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে। # এভাবেই কত কিছু পুড়ল! কীইবা বেচে রইল; তা জানতে হলে পুরোটা পড়তে হবে চরিত্রহীনা।
পেশা অধ্যাপনা। কিন্তু নেশা তাঁর শব্দ নিয়ে খেলা। বাজারে এই লেখকের কোনো কবিতার বই নেই। তবুও নিজেকে কবি হিসেবে পরিচয় দিতে বড্ড পছন্দ করেন তিনি। সহজ-সরল-প্রাঞ্জল ভাষায় লেখক ফুটিয়ে তোলেন হাজারো তরুণ মনের প্রেম, বিরহ, বেদনা, দ্রোহ, প্রতিবাদ। লেখকের প্রথম উপন্যাস 'ফ্যান্টাসি' তরুণ প্রজন্মের মাঝে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। 'কষ্টকথা সাফল্যগাথা' এখনও তরুণ-তরুণীদের সামনে এগুবার প্রেরণা দিয়ে চলেছে। করোনাভাইরাসের প্রেক্ষাপটে লেখা বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস 'করুণাহীন করোনার দিন' তুমুল সাড়া ফেলেছে। 'দহন', 'কবি', 'কিছু কথা কিছু ব্যথা, 'সবই কি মিথ্যা ছিল?' প্রতিটি উপন্যাসই পাঠক-পাঠিকাদের পছন্দের শীর্ষে। লেখকের জন্ম ২৫ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের বাসাইল থানাধীন কাউলজানী নামক নিভৃত পল্লিতে। মা আজিজা খানম ও বাবা প্রয়াত মুক্তিযোদ্ধা (যদিও মুক্তিযুদ্ধের সনদ তিনি সংগ্রহ করেননি।) শাজাহান খান। অর্ধাঙ্গিনী নূর-এ ফাহমি ও একমাত্র তনয় শাহ জাবির খান হুরাইরাকে নিয়ে লেখক সুখী পারিবারিক জীবনের অধিকারী। লেখকের স্বপ্ন একজীবন লিখে যাওয়া।