মানব সভ্যতার ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব হলেন ইসলামের শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (স.)। তাঁর ওফাতের পর মুসলিম জাহানের চারজন খলিফা ছিলেন। তাঁরা হলেন : হজরত আবুবকর, হজরত ওমর, হজরত ওসমান এবং হজরত আলী। এই চারজন খলিফাকে বলা হয় ‘খোলাফায়ে রাশেদীন’ বা ‘শিষ্টাচারী খলিফা চতুষ্টয়’। এই খলিফা চতুষ্টয়ের জীবন দর্শন সঠিকভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে না পারলে তাঁদের উপর হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর জীবন দর্শনের প্রভাব কতখানি তা বোঝা যাবে না। শুধু তা-ই নয়, খলিফা চতুষ্টয়ের আদর্শের সাথে হজরত মোহাম্মদ (স.)-এর জীবনাদর্শের এতই মিল যে, এই পাঁচজনের শিক্ষাকে একত্রে অনুধাবন করা গেলে মুসলিম অমুসলিম নির্বিশেষে ইসলাম সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে। এই উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় বাঙ্লা উন্নয়ন বোর্ড ১৯৬৪ সালে প্রত্যেক খলিফার উপর বই লেখার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তারই ফসল বাংলাভাষায় রচিত মহানবীসহ খোলাফায়ে রাশেদীন বা চার খলিফার জীবনী।
১৯২৬ সালে ঢাকায় একদল তরুণ শিক্ষক ও ছাত্র দ্বারা গঠিত হয় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’। এই সমাজের মূল উদ্দেশ্য ছিল বুদ্ধির মুক্তি এবং মূলমন্ত্র ছিল : ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এই বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। তিনি মনে করতেন, মুক্ত-বিচার-বুদ্ধির সাথে ইসলামের বিন্দুমাত্র বিরোধ নেই। তাঁর ওই চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ঘটেছে হযরত মোহাম্মদ ও ইসলাম শীর্ষক গ্রন্থটিতে। মহানবীর প্রতি লেখকের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা এবং অপরিমেয় কৌতূহল সম্পূর্ণ বিচার-বুদ্ধির দ্বারা চালিত হয়েছে। আর সে কারণেই গ্রন্থটি হতে পেরেছে একজন জীবন্ত মানুষের জীবনী। ইসলামি জাগরণের কবি গোলাম মোস্তফা বিশ্বনবী লেখার ২২ বছর পর লিখলেন হজরত আবু বকরের জীবনী। কথা ছিল চার খলিফার উপরই তিনি লিখবেন কিন্তু অসময়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে যাবার কারণে এই দায়িত্ব ভাগ হয়ে গেলে ইতিহাসবিদ এবং তৎকালীন বিচারপতি আবদুল মওদুদ লিখলেন হজরত ওমরের জীবনী। খ্যাতিমান লেখক এবং বিশিষ্ট মুতাজিলা দার্শনিক মুহম্মদ বরকতুল্লাহ সারাজীবন মূলত মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক গবেষণা ও লেখার সাথে জড়িত ছিলেন। পারস্য প্রতিভা গ্রন্থখ্যাত লেখক বরকতুল্লাহ লিখলেন হজরত ওসমানের জীবনী। হজরত আলীর জীবন কথা লেখার জন্য দায়িত্ব পেলেন বুদ্ধিমুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক বিশিষ্ট সাহিত্যিক অধ্যাপক আবুল ফজল। হজরত আলীর জীবন সম্পর্কে বিভিন্ন উপকরণ যা বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান ছিল তা তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ও সুশৃঙ্খলভাবে সংগ্রহ করে তাঁর অসাধারণ ভাষায় লিপিবদ্ধ করলেন। প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান ‘সংবেদ’ বাংলাভাষায় রচিত বিশিষ্ট ওই লেখকদের অসামান্য সেই গ্রন্থগুলিকে একত্রে আপনাদের হাতে তুলে দিতে পেরে আনন্দিত।
জন্ম : ২৬ এপ্রিল ১৮৯৪, নদীয়া (বর্তমান কুষ্টিয়া) জেলার জগন্নাথপুরে মামার বাড়িতে। পৈত্রিক নিবাস তৎকালীন ফরিদপুর জেলার পাংশা থানার বাগমারা গ্রাম। পিতা কাজী সৈয়দ হােসেন ওরফে সগীরউদ্দীন। মুসলিম সাহিত্য সমাজ’-এর প্রতিষ্ঠাতা ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন’-এর অন্যতম সংগঠক ছিলেন কাজী আবদুল ওদুদ। শিক্ষা : ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯১৯ সালে এমএ পাস করেন। কর্মজীবন : ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজে বাংলার অধ্যাপক হিসেবে যােগদান। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে টেক্সট বুক বাের্ডের সেক্রেটারি রূপে কলকাতায় যান। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অবসর গ্রহণ। প্রকাশিত গ্রন্থ : নবপর্যায় (প্রথম খণ্ড-১৩৩৩), (দ্বিতীয় খণ্ড-১৩৩৬), রবীন্দ্রকাব্য পাঠ (১৩৩৪), সমাজ ও সাহিত্য (১৩৪১), হিন্দু-মুসলমানের বিরােধ (১৩৪২), আজকার কথা (১৩৪৮), কবিগুরু গ্যেটে (১ম খণ্ড-১৩৫৩), (২য় খণ্ড-১৩৫৩), নজরুল প্রতিভা (১৩৫৫), Creative Bengal (১৯৫০), শাশ্বত বঙ্গ (১৩৫৮), স্বাধীনতা দিনের উপহার (১৯৫১), কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ (১ম-১৩৬২, দ্বিতীয়-১৩৭৬), বাংলার জাগরণ (১৩৬৩), শরৎচন্দ্র ও তারপর । (১৯৬১), হযরত মােহাম্মদ ও ইসলাম (১৩৭৩)। পুরস্কার : ১৯৭০ খ্রিস্টাব্দে শিশিরকুমার পুরস্কার লাভ। মৃত্যু : ১৯ মে ১৯৭০ সালে কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন।