সফিক উল্লাহ প্রণীত আত্মকাহিনীমূলক গ্রন্থ 'এক পুলিশের ডায়েরি' সম্পর্কে দু'চার কথা লিখতে স্বেচ্ছায় প্রণোদিত হয়েছি। সফিক উল্লাহ পুলিশ বাহিনীর এক সফল কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ১৯৭৩ সালে এসপি (বর্তমানে ডিএসপি) পদে যোগদান করে ডিআইজি পদে উন্নীত হন এবং ২০০২ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে অবসর গ্রহণ করতে বাধ্য হন। মজার বিষয় হলো, সফিক উল্লাহ হতে চেয়েছিলেন শিক্ষক। ভাগ্যচক্রে হয়ে গেলেন পুলিশ। এ নিয়ে তার কোনো আক্ষেপ নেই। তা না হলে তিনি কি এমন বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী হতে পারতেন? ৩৫২ পৃষ্ঠার বইটি আমি বিমোহিত চিত্তে পাঠ করেছি। আমার যৌবনকালে আরেকজন পুলিশের আত্মকথা এমন মুগ্ধ চিত্তে পড়েছিলাম। বইটির নাম 'যখন পুলিশ ছিলাম'; ধীরাজ ভট্টাচার্যের আত্মকাহিনীমূলক গ্রন্থ। ধীরাজ ভট্টাচার্য ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের প্রমথেশ বড়ুয়া-পরবর্তী এবং উত্তম কুমার-পূর্ববতী যুগের চলচ্চিত্র নায়ক; পরবর্তীকালে খলনায়ক। তার আরেকটি আত্মজীবনীমূলক 'যখন নায়ক ছিলাম' গ্রন্থও আমি পড়েছি। যা হোক, ধীরাজ ভট্টাচার্যের 'যখন পুলিশ ছিলাম' মূলত একটি বিয়োগান্ত প্রেমকাহিনী, যার ঘটনাস্থল কক্সবাজার জেলার টেকনাফ। আলোচ্য সফিক উল্লাহর আত্মকথায় উঠে এসেছে বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ, পরবর্তী বিজয় তথা আমাদের স্বাধীনতা অর্জনের দুঃখ-কষ্ট-আনন্দের এক অম্লমধুর বিবরণ। সফিক উল্লাহর চাকরি জীবন ২০০২ সালে সমাপ্ত হলেও পরে তিনি জাতীয় নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বিভাগে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সফিক উল্লাহর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি তার পেশাগত জীবনে দেখেছেন জাতীয় জীবনের নানা উত্থান-পতন, রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম ও সংকটকাল। পাশাপাশি তিনি দেখেছেন সুন্দর ও সুখের সময়। আরও দেখেছেন আমাদের জাতীয় জীবনের খরা ও দুঃখকাল। এক কথায়, তিনি কঠোর পেশাজীবী হিসেবে পছন্দ-অপছন্দের তরঙ্গময় সময় পর্যবেক্ষণ করেছেন। নিজের ভালোবাসা ও ভালো লাগাকে জলাঞ্জলি দিয়ে তিনি নিরাসক্ত এক সন্যাসীর মতো পেশাদারি কর্তব্য পালন করেছেন। অন্তরের গভীরে তিনি রক্তাক্ত হয়েছেন; ফুঁসে উঠতে চেয়েছেন সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে, কিন্তু তা তিনি সব সময় পারেননি তার পেশার পবিত্র দায়িত্বকে স্মরণ করে। একজন পেশাজীবীকে নিজ ভালোবাসা পরিত্যাগ করে দায়িত্ব পালন করাটা প্রধান হয়ে ওঠে। এ যেন নিজের সঙ্গেই নিজের এক রক্তাক্ত সংগ্রাম। ঘরে বসে তিনি সুখে আন্দোলিত হতে পারেন এবং দুঃখে ভারাক্রান্ত হতে পারেন, কিন্তু তার প্রকাশ তিনি করতে পারেন না। এ বড় কঠিন কাজ। তিনি যে রাষ্ট্রের কর্মচারী, তাও আবার উর্দি পরা। একজন লেখক রাগে-দুঃখে কলম ছুড়ে ফেলতে পারেন। একজন শিল্পপ্পী, সংস্কৃতিকর্মীর পক্ষে সবকিছু ছেড়েছুড়ে দেওয়া সম্ভব। এমনকি, একজন রাজনীতিবিদও চাইলে অপছন্দের রাজনীতিচর্চা ছেড়ে দিতে পারেন, দল বদল করতে পারেন। কিন্তু একজন উর্দি পরা পেশাজীবীর পক্ষে তা সম্ভব নয়। সফিক উল্লাহর সাবলীল বর্ণনা নদীর স্রোতের মতো সতত প্রবহমান। তরতরিয়ে চলে এবং সর্বোপরি সুখপাঠ্য। সফিক উল্লাহ একজন দেশপ্রেমিক ও মানবপ্রেমিক। তার লেখনী নতুন দ্যোতনায় এক উচ্চমার্গে প্রবেশ করেছে যখন তিনি স্বীকারোক্তি দিয়ে লেখেন; অনেক কথা বলতে পারেননি, প্রতিবাদে মুখর হতে পারেননি, কারণ পুলিশের মতো একজন পেশাজীবী কখনও পক্ষপাতিত্ব করতে পারেন না এবং রাজনীতিও করতে পারেন না, যদিও সফিক উল্লাহ একজন মুক্তিযোদ্ধা। শুধু তাই নয়; তিনি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুগামী এক বাঙালি, যিনি স্বদেশের আবহমান সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী; সর্বোপরি বাঙালী জীবন ও বাঙালিত্বকে নিয়ে গৌরব বোধ করেন। তার কাছে মাতৃভূমি বাংলাদেশই প্রথম ও শেষ কথা।
-আতাউর রহমান, নাট্যকার, ২০২১ সালের স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত