"যুদ্ধদিনের নীলখাতা" বইটির ভূমিকা থেকে নেয়াঃ ‘যুদ্ধদিনের নীল খাতা' মূলত আমার বালিকাবেলার স্মৃতিগদ্য। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে গানের প্রতি প্রচণ্ড ঝোঁক আমাকে নানাভাবে আলােড়িত করেছে। জীবনে ছায়াসহচরীর মত পেছনে পেছনে চলেছে গান। গানের প্রতি ভালােবাসাই গানের সাথে আমার জীবনের গাঁটছড়া বেঁধে দিয়েছিল। কিন্তু জীবনের নানা চড়াই উৎরাই পেরিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেও শিল্পের অঙ্গনে আমি গানকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। গানের জন্য মনের মধ্যে ভাই এক গােপন বেদনা বয়ে বেড়াই। ২০২০ সনে করােনা মহামারীর কারণে যখন বহিরাঙ্গণে আমাদের কর্মজীবন স্থবির হয়ে পড়ে, সে সময়ে মনের স্থিরতার জন্য গান নয় জীবনকাহিনি নামে ফেসবুকে একটি ধারাবাহিক স্মৃতিগদ্য লিখতে শুরু করেছিলাম। সে লেখায় প্রথম আট দশ পর্বে গানের প্রতি ভালােবাসার কথাই ব্যক্ত হলাে। আমারও লক্ষ্য থাকলাে, লেখায় মূলত সংগীতপ্রেমকে ফোকাস করা। কিন্তু লিখতে গিয়ে আমার স্মৃতিময় দিনগুলাে যখন উনিশশাে আটষট্টির চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকে পড়লাে উনসত্তরে, সত্তরে, সে সময়ে কলম উঠলাে বেয়াড়া হয়ে। তাকে আর থামানাে গেল না, শুধু গানের খেয়া বাইতে সে রাজি নয়, সময়ের ব্যথা লিখতে চায়। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে উনসত্তর-সত্তর এক উত্তাল আন্দোলনের ঝল। যে আন্দোলন বাংলার মানুষকে উদ্দীপ্ত করছিল স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায়, তৈরি করছিল লাঙল জোয়াল কাস্তেকোদাল খাতাকলম ফেলে রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে নিয়ে যুদ্ধ করবার জন্য, উত্তাল সেই গণআন্দোলনের ঢেউ লাগে জনজীবনে, শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে তার অভিঘাত। আমার বালিকাজীবনও সেই অভিঘাত থেকে মুক্ত থাকে না। আমি, আমরা, যেন হয়ে উঠি একাত্তরের প্রজনা, দীর্ঘদিনের বিদেশী শাসনশােষণ বঞ্চনা আর নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পেতে ব্যাকুল এক যুযুধমান দেশের নাগরিক! কাজেই আমার গান নয় জীবনকাহিনি'-র পরবর্তী পর্বগুলাে উনসত্তর থেকে একাত্তর কালপর্বের স্মৃতি আকারেই লিখিত হতে থাকে। সে সময়টাতে আমরা ছিলাম বিক্রমপুরে, মুন্সিগঞ্জের গনাইসার গ্রামে আমার নানাবাড়িতে। আব্বা চাকরি করেন ঢাকায়। ঢাকা তখন যুদ্ধের নগরী। আব্বার এলাকায়ও হলাে আর্মি রেইড। প্রচও অনিশ্চয়তা আর ভয় নিয়ে যুদ্ধের মধ্যে থেকে আব্বা চাকরি নামের যুদ্ধ করতে লাগলেন। ওদিকে আটজন সন্তানসন্ততি নিয়ে আমার আম্মাও গ্রামে এক কঠিন জীবনযুদ্ধ চালাতে লাগলেন। একাত্তরে সারা দেশ যুদ্ধে রত, চারদিকে হত্যা রক্ত মৃত্যু ধংস। দেশ তাে নয়, এক ভয়ের জনপদ! রােজগেরে মানুষদের রােজগার বন্ধ, জিনিসপত্রের দাম ঊর্ধর্বমুখী, গ্রামের পরিবারগুলোর কাধে শহর থেকে পালিয়ে-আসা শরণার্থী পরিবারের বােঝা, প্রতি মুহূর্তে মিলিটারি আসার ভয়, আক্রান্ত হওয়ার ভয় - এইসব শংকা ভয় সংকট সমস্যা আর অনিশ্চয়তা একজন এগারাে বারাে বছরের বালিকাকে কীভাবে আন্দোলিত করেছিল, কীভাবে আলােড়িত করেছিল তার দিনযাপনকে – সেই আলােড়নগুলাে আমাকে দিয়ে লিখিয়ে নেয় পরবর্তী কয়েকটি পর্ব। 'যুদ্ধদিনের নীলখাতা' মূলত ‘গান নয় জীবনকাহিনি'র সেই পর্বগুলাের একটি সম্পাদিত রূপ। বইটির নামকরণ প্রসঙ্গেও দু-একটি কথা বলার আছে। ফেসবুকে প্রকাশিত হওয়া আমার লেখাটির অন্যতম আগহী পাঠক ছিলেন পশ্চিমবঙ্গ নিবাসী বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক উত্তরা চক্রবর্তী। তিনি বিক্রমপুরের মেয়ে। যুদ্ধকালীন পর্বগুলাে পড়ে তিনি এ লেখাগুলােকে দ্রুত বই আকারে প্রকাশ করার কথা বলতে গিয়ে বলেছিলেন, “কী নাম দেবেন, নীলখাতা?' কিন্তু উত্তরাদি আমার বইটি দেখে যেতে পারলেন না। করােনায় আক্রান্ত হয়ে তিনি ২৯.১১.২০ তারিখে প্রয়াত হন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে বইয়ের নামন্ত্রণে ‘নীলখাতা' শব্দটি রাখলাম। বইটি প্রকাশ করে এই শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের সুযােগ করে দেওয়ার জন্য প্রকাশক পাশা মােস্তফা কামাল ও শায়লা রহমান তিথিকে জানাই অশেষ ধন্যবাদ। একাত্তরে পরিবেশ-পরিস্থিতি অপরিণত বয়স নানা কারণে আমার পক্ষে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেয়া সম্ভব হয়নি, কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপকতা নির্ণয় করতে গেলে বােঝা যায়, সারা দেশই তখন ছিল যুদ্ধক্ষেত্র, আর বিশ্বাসঘাতক রাজাকার আলবদর আলশামস ইত্যাদি কুলাঙ্গার ছাড়া সাড়ে সাত কোটি মানুষের সবাই ছিল মুক্তিযােদ্ধা। কাজেই বালিকা হলেও, আমিও ছিলাম সেই যুদ্ধের এক লড়াকু পরিবারের গৃহাঙ্গন-সৈনিক!
চল্লিশ বছর ধরে লেখালেখির সাথে যুক্ত আছেন। ১৯৮০ সনে বাংলাদেশ পরিষদ আয়োজিত একুশে সাহিত্য প্রতিযোগিতায় ছোটগল্পে জাতীয় পুরস্কার প্রাপ্তির মধ্য দিয়ে সাহিত্যক্ষেত্রে তাঁর আত্মপ্রকাশ। গল্প উপন্যাস, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, নাটক, কবিতা, ভ্রমণ-শিশুসাহিত্য, সবক্ষেত্রেই তাঁর বিচরণ। গল্পকার হিসেবে বিশেষভাবে পরিচিত। তার প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা প্রায় ৬০টি। পেশাগত জীবনে তিনি বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ রাইফেলস পাবলিক কলেজের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক। বেতার ও টেলিভিশনের নিয়মিত কণ্ঠশিল্পী। বাংলা ভাষার কথাসাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালে অনন্যা সাহিত্য পুরস্কার-১৪২৭ লাভ করেন। জন্ম ২৮ জুন, ১৯৫৯, গ্রামে বাড়ি : কেওয়ার, মুন্সিগঞ্জ।