বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে প্রতিটি হাঁটা-পথের মানুষ তার নিজ-নিজ পেশা ও ভালো-লাগার ক্ষেত্রে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মিলিয়ে নিচ্ছে। ‘পারফর্মিং আর্ট’ ‘বিতর্কের’র ক্ষেত্রে বাংলাদেশের বিতার্কিকরা প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির খেরোখাতা খুলে বসেছে স্বাভাবিক নিয়মেই। বিতার্কিক মেহেদীর ‘এবং বিতর্ক’ গ্রন্থটি একটু সেরকমই হিসাবের খাতা।
এই গ্রন্থটি বাংলাদেশের বিতর্ক জগতে যে চিন্তার মেদ জন্মেছে, যে ‘মিডিওক্রেসির’ কোলাহল তৈরি হয়েছে, ইতিহাস নির্মাণের আগেই ইতিহাসের নাম লেখানোর যে ঢাকার নাগরিক সমাজের প্রচেষ্টা, তারই উপজাত বিতর্কের মস্তিষ্কেও জন্মেছে; এসব প্রশ্ন উত্থাপন করেছে সঙ্গতভাবেই।
বিতর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ টেলিভিশন বিতর্কের শস্যক্ষেত্রে যে যুক্তিবাদী সমাজ গড়ার চিন্তা জারিত হয়েছিল, তাও এক সময় বাংলাদেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো অযৌক্তিক দ্বি-দলীয় ‘গ্যাং-কালচারের’ অনুপ্রবেশে ‘মিডিওকার’ কিরণমালার আসর কিংবা খানিক প্রশান্ত থেকে তারপর বিতর্কের সুভাষী সিংহ হুংকারের ‘ভিলেজ-পলিটিক্সের’ ভাটিয়ালি হিজল-তমাল হয়ে উঠেছে। বাতাবি লেবু-গন্ধী টিভিগুলোতেও এসব বিতর্ক প্রচেষ্টা চোখে পড়ে না, যা বিতর্কের সোনালি যুগের শিল্পের পাশে দাঁড় করালে এই ‘পারফর্মিং আর্টের’ অধোঃগতির দুসংবাদ দেয়।
বিতর্কের ক্লাবগুলো হয়ে পড়েছে দলীয় আশিকদের ছানার জিলাপির দোকান যেন। রাজদরবারের বিদূষক হবার ইঁদুর-দৌড়ে বাকচাতুর্যকে টেকাটুকা উপার্জনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করায় বিতর্ক রূপান্তরিত হয়েছে কিরণমালার চিংড়ির ঘেরের নেয়ামত কিংবা ‘ফেইক’ ব্যোমকেশ বকশীদের ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকার’ কুম্ভীরাশ্রু সদনে। যুবরাজের অভিষেক মঞ্চ হয়ে দাঁড়িয়েছে; এই বিতর্কের স্ফীত উদরের দাস-মনোবৃত্তির বিতার্কিকদের অদৃশ্য সাবানে হাত কচলানোর অনুশীলনে। ফলে বিতর্কের মাঝ দিয়ে যে ঋজু বাঙালি মনীষার নবজাগরণ ঘটানোর কথা ছিল, তা না হয়ে বিতর্ক হয়ে দাঁড়িয়েছে সহমত ভাইয়ের সৌরভ ছড়ানোর বিনিময়ে হীরা কুড়ানোর বুলবুলি আখড়াই।
গ্রিসের ‘গিমনেশিয়ামের’ আদলে যেখানে আলোকসম্ভবা বাংলাদেশের নতুন চিন্তার ঝলকানি ওঠার কথা ছিল, সেই বিতর্ক-ঘর এখন মৌ-মৌ করছে লিলিপুটিয়ান ও ব্লেফুসকুডিয়ানদের চর দখলের জন্য তির-ধনুকের স্ল্যাং-এর ছিপি-খোলা লড়াই আর স্থূলচিন্তার ভাঁড়দের ‘হোলিয়ার দ্যান দাউ’ হবার খোয়াড়িতে। এসবই মেহেদীর ‘এবং বিতর্ক’ গ্রন্থে উত্থাপিত প্রশ্নের জায়গা; অশুভের বিরুদ্ধে একটি শুভ বিতর্কের পাণ্ডুলিপি এই গ্রন্থটি। —মাসকাওয়াথ আহসান
কথাসাহিত্যিক, গবেষক ও ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট। জন্ম ফরিদপুরে। তার লেখালেখি ও গবেষণার ক্ষেত্র নানামুখী। ছাত্রাবস্থায় পাঠ্য মধ্যযুগের দুটি মঙ্গলকাব্য (চণ্ডীমঙ্গল ও অন্নদামঙ্গল) ও একটি রোমান্টিক প্রণোয়োপাখ্যান (লায়লী-মজনু) সম্পাদনা ও চলিত গদ্যে রূপান্তর করেন। বাংলাদেশের বিতর্ক আন্দোলনের পরিচিত মুখ মেহেদী। যুক্ত ছিলেন বাংলাদেশ ডিবেট ফেডারেশনে। তার গবেষণায় উঠে এসেছে ফরিদপুরের পাঁচ দশকের বিতর্কের ইতিহাস! ফরিদপুরে তার উদ্যোগে গড়ে উঠেছে একাধিক বিতর্ক সংগঠন। তিনি ডিবেটার্স ফোরাম অব ফরিদপুর (ডিএফএফ)-এর আহ্বায়ক ও প্রথম সভাপতি ছিলেন। চলচ্চিত্র সংসদ আন্দোলনেও যুক্ত আছেন মেহেদী।