জীবনে ও কবিতায় সমান লড়াকু অথচ বস্তু-নির্মোহ মানবিক চেতনায় ঋদ্ধ যে ক’জন কবি সারা পৃথিবীতে সর্বজনীনÑতাদের মধ্যে মোহন রায়হান অন্যতম। কবি মোহন রায়হান আপাদমস্তক প্রতিবাদী, সাহসী, মুক্তপ্রাণ, মুক্তচিন্তার এক বিপ্ল−বী কবি। যখন সমাজে ঘুণের কোরাস, শস্যের মাঠে ইটভাটার লেলিহান বাণিজ্য, যখন কবিতার গোলাঘরে ধেড়ে ইঁদুর, যখন নৈতিকতার গোরস্তানে প্রতিদিন অগণ্য কবর, তখন মোহনের কবিতায় ঝলসে ওঠে লালাভ অগ্নিনিঃশ^াস। তিনি দ্রোহের ইস্পাতফলায় হৃদয়ের লাল জমিন খুঁড়ে চাষ করেন কবিতা, পাশাপাশি ফুটে ওঠে থোকা থোকা জ্বলন্ত অঙ্গারের মতো রক্তদ্রোণ আর অশ্র“জবা শব্দ। এ কবির শিরোদেশে শোভা পায় বিপ্ল−বের লাল টুপি। তেমনি তার কবিতাও যেন রক্ত¯্রােতের লাল চিৎকার, অগ্নিদহনের লাল উৎসব, যোদ্ধার হাতের স্টেনগান থেকে ছিটকে পড়া লাল বারুদের স্ফুলিঙ্গ। প্রতিটি কাব্যগ্রন্থেই এই কবি যেন এক দুরন্ত লালকর। একই সঙ্গে তার কবিতা দুঃখের মোহনায় আছড়ে পড়া নোনা জলের ঢেউ। প্রেমের গভীর আবেগ, হতাশার দীর্ঘনিঃশ^াস, বিশ^াস আর স্বপ্নভঙ্গের বেদনা তার কবিতায় গেঁথে দেয় অশ্র“র স্ফটিক, শব্দের শরীরে লেগে থাকে শিশিরের ভেজা ঠোঁটের চুমু, রক্তক্ষরা হৃদয়ের উষ্ণ ছোঁয়া। বাংলাদেশের কবিতার ভুবনে স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল কবি মোহন রায়হান। তার জীবন স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক তথা সাংস্কৃতিক মুক্তিসংগ্রামেরই বেদনাসিক্ত উপাখ্যান। সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকারসংবলিত সমাজ প্রতিষ্ঠার জন্য যে বৈজ্ঞানিক সমাজদর্শনে তিনি যৌবনে ঋদ্ধ হয়েছিলেন, তার প্রতি অবিচল আস্থা ও আনুগত্য সংশপ্তক স্বরে ধ্বনিত হয়েছে তার প্রায় সব গ্রন্থে। সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রামে অসামান্য ত্যাগী, প্রগতিশীল শক্তি আজ নানাভাবে বিভক্ত। সাধারণ মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য মোহন চেয়েছেন এই প্রগতিশীল শক্তির অপরাজেয় ঐক্য। তার বিভিন্ন কবিতায় তিনি এই ঐক্যকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। জাপানে আয়োজিত ‘টোকিও বাংলা বইমেলা ২০১৯’ উপলক্ষে প্রকাশিত মোহনের এ গ্রন্থটি বিভিন্ন সময়ে তার লেখা উল্লে−খযোগ্য কিছু কবিতার সংকলন। আশা করি, নতুন-পুরাতন সব পাঠকই এ কবিতাগুলো থেকে মোহন এবং তার কবিসত্তাকে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
মােহন রায়হান। বাবা ফরহাদ হােসেন ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামে ‘আজাদ হিন্দ । ফৌজ’-এর সৈনিক ছিলেন। মা মাহমুদা খাতুন। সমাজসেবী। ১৯৫৬ সালের ১ আগস্ট সিরাজগঞ্জে জন্ম। ১৯৮০-৮২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর। দ্রোহ-প্রতিবাদ, লড়াই-চেতনা, প্রেম-প্রকৃতি ও জীবনের গভীরতম অনুভূতির কবি। সমাজ বদলের আপসহীন সৈনিক বলিষ্ঠ সংগঠক। প্রাক্সিস অধ্যয়ন সমিতি, বাংলাদেশ লেখক শিবির, আবৃত্তি সংসদ, অরণি, রাখাল, বাংলাদেশ । ছাত্রলীগ, কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-এর সাবেক সংগঠক ও নেতা। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, জাতীয় কবিতা পরিষদ-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। অগ্নিঝরা একাত্তরে সিরাজগঞ্জে স্থাপিত ‘জয় বাংলা বেতার কেন্দ্র’-এর কবি। কবিতাপত্র দিকচিহ্ন ও “সাপ্তাহিক দিকচিহ্ন'-এর সম্পাদক। বাংলাদেশে বিনা অপারেশনে ‘হৃদরােগ থেকে মুক্তি এবং “বিনা তেলে রান্না আন্দোলনের পথিকৃৎ। সাওল হার্ট সেন্টার (বি.ডি.) লিমিটেড-এর চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মােহন রায়হান স্বৈরাচার ও সামরিক দুঃশাসনের শেকড় উপড়াতে বারবার জেল-জুলুম নির্যাতন সয়েছেন, দাঁড়িয়েছেন সামরিক আদালতের কাঠগড়ায়। তিনি ভারত, থাইল্যান্ড, হংকং, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, জাপান, মালয়েশিয়া, ইরান প্রভৃতি দেশে কবিতাপাঠ ও রাজনৈতিক সেমিনারে অংশগ্রহণ করেন।