সুরা ফাতেহা এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৭টি আয়াত, ২৫টি শব্দ, ১২৩টি অক্ষর ও ১টি রুকু। ইহার অপর নাম ‘সাবাউল মাসানী’। ‘সাবা’ অর্থ সাত; ‘মাসানী’ অর্থ পুনঃপুন। ফাতেহা – উদ্ঘাটিকা। এই ‘সুরা’ দিয়াই পবিত্র কোর-আন শরিফের আরম্ভ। এইজন্য এই সুরার নাম ‘ফাতেহা’। ইহা কোর-আনের শেষ খণ্ড আমপারায় নাই, ইহা কোর-আন শরিফের প্রথম খণ্ডের প্রথম ‘সুরা’। নামাজ, বন্দেগী, প্রার্থনা প্রভৃতি সকল পবিত্র কাজেই সুরা ফাতেহার প্রয়োজন হয় বলিয়া আমপারার সঙ্গে ইহার অনুবাদ দেওয়া হইল। শানে-নজুল–(অবতীর্ণ হইবার কারণ)—একদা হজরত মোহাম্মদ (দঃ) মক্কার প্রান্তর অতিক্রম করিবার সময় দৈববাণী শুনিতে পাইলেন, মোহাম্মদ! আমি স্বর্গীয় দূত জেব্রাইল, আপনি পয়গম্বর, আমি শপথ করিতেছি–আল্লাহ্ ভিন্ন আর কোন উপাস্য নাই, মোহাম্মদ (দ.) আল্লাহ্র রসুল (তত্ত্ববাহক)। আপনি বলুন, আলহামদোলিল্লাহ্—সকল প্রশংসাই বিশ্বপতি আল্লার, ইত্যাদি। (–তফসীরে আজিজী ও তফসীরে মাজহারী) সুরা নাস মদিনা শরীফে অবতীর্ণ; ইহাতে ৬টি আয়াত, ২০টি শব্দ, ৮১টি অক্ষর ও ১টি রুকু আছে। ‘নাস’ অর্থ মানুষ। (কোর-আন শরিফের মোট ১১৪টি সুরার মধ্যে এইটিই শেষ সুরা)। সুরা ফলক মদিনা শরিফে অবতীর্ণ; ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৩টি শব্দ, ৭৩টি অক্ষর ও ১টি রুকু। ‘ফলক’ – উষা, প্রাতঃকাল। ইহা কোর-আনের ধারাবাহিক ১১৩ নং সুরা। শানে-নজুল–মদিনা শরীফের অধিবাসী লবিদ নামক একজন ইহুদীর কয়েকটি কন্যা ছিল। তাহারা হজরত নবী করিমের মাথার কয়েকটি চুল ও চিরুনির কয়েকটি দাঁতের উপর জাদুমন্ত্র পাঠ করিয়া এগারোটি গ্রন্থি দিয়াছিল এবং তাহা এক একটি খোর্মা মুকুলের মধ্যে রাখিয়া ‘যোরআন’ নামক কূপের তলদেশস্থ প্রস্তরের নীচে স্থাপন করিয়াছিল। এই জাদুর দরুন হজরতের শরীর এরূপ অসুস্থ হইয়াছিল যে, তিনি যে কাজ করেন নাই তাহাও করিয়াছেন বলিয়া কখনও কখনও তাঁহার ধারণা হইত। হজরত ছয় মাস কাল যাবৎ এরূপ ব্যাধিগ্রস্ত ছিলেন। এক রাত্রে তিনি স্বপ্নে জানিতে পারিলেন তাঁহার ওই পীড়ার কারণ কী। প্রাতে হজরত আলী, আম্মার ও জোবায়েরকে ‘যোরআন’ কূপের দিকে প্রেরণ করেন। তাঁহারা উক্ত কূপের তলদেশ হইতে ওইসব দ্রব্য তুলিয়া হজরতের নিকট নিয়া হাজির করেন। তখন জিব্রাইল ‘ফলক’ ও ‘নাস’ এই দুই সুরা সহ অবতরণ করেন। এই দুই সুরায় এগারোটি আয়াত আছে। তিনি এক এক করিয়া ক্রমান্বয়ে এগারোটি আয়াত পাঠ করিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে এক এক করিয়া উহার এগারোটি গ্রন্থি খুলিয়া গেল। অতঃপর হজরত সম্পূর্ণরূপে রোগ হইতে মুক্তি লাভ করিলেন। (–এমাম এবনে কছির, জালালায়ন, কবির।) এস্থলে ইহাও উল্লেখ করা যাইতে পারে যে, জাদুমন্ত্র দ্বারা মানুষের শারীরিক ক্ষতি হওয়া অসমীচীন নয়; কিন্তু সর্বশ্রেষ্ঠ মহাপুরুষ জাদুমন্ত্র-প্রভাবে স্বর্গীয় আদেশ প্রচারের কালে বিকারগ্রস্ত হইয়াছিলেন এরূপ ধারণা করা বাতুলতা মাত্র। —(কবির, হাক্কানী) সুরা ইকলাস এই সুরা মক্কা শরীফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৪টি আয়াত, ১৭টি শব্দ, ৪৯টি অক্ষর ও ১টি রুকু আছে। শানে-নজুল–মক্কার অধিবাসী কতিপয় কাফের হজরতকে জিজ্ঞাসা করিয়াছিল, আল্লাহ্ কী উপাদানে গঠিত? তিনি কী আহার করেন? তাঁহার জনক কে? ইত্যাদি; তদুত্তরে এই সুরা নাজেল হয়। এমাম কাতাবা বলেন—’সামাম’ অর্থ-যিনি পান-আহার করেন না। এই শব্দের—অভাব রহিত, শ্রেষ্ঠতম, অনাদি, নিষ্কাম, অনন্ত ইত্যাদি বহু অর্থ আছে। আল্লাহ্ কাহারও মুখাপেক্ষী বা সাহায্যপ্রার্থী নন, সকলেই তাঁহার সাহায্যপ্রার্থী; তিনি বে-নেয়াজ। এই সুরায় অংশীবাদী ও পৌত্তলিকদের মতবাদকে খণ্ডন করা হইয়াছে। –(কবীর, কাশ্শাফ, বায়জাবী।) সুরা লহব্ মক্কায় অবতীর্ণ; ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৪টি শব্দ, ৮১টি অক্ষর। শানে-নজুল–বোখারী ও মোছলেম প্রভৃতি টীকাকারদের মতে খোদাতালা হজরতের আত্মীয়-স্বজনদের সম্বন্ধে শাস্তির ভীতি প্রদর্শনসংক্রান্ত আয়ত অবতীর্ণ করিলে তিনি সাফা পর্বতের উপর আরোহণ করিয়া আরবের তদানীন্তন নিয়মানুসারে উচ্চৈঃস্বরে ‘সাবধান’ ‘সাবধান’ বলিয়া চিৎকার করিতে থাকেন। তাহাতে কোরায়েশ বংশের অনেক লোক তথায় উপস্থিত হইয়া হজরতকে জিজ্ঞাসা করে, কী হইয়াছে? হজরত তাহাদের সম্বোধন করিয়া বলিলেন যে, যদি আমি বলি যে, একদল শত্রু তোমাদিগকে আক্রমণ করিবার জন্য পর্বতের অপর পার্শ্বে উপস্থিত হইয়াছে, তবে তোমরা আমার এই কাজের প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করিবে কি? তদুত্তরে তাহারা বলিল, নিশ্চয় বিশ্বাস স্থাপন করিব। আমরা বেশ পরীক্ষা করিয়াছি, আপনি কখনও মিথ্যা কথা বলেন না। তৎপরে হজরত বলিলেন,–হে কোরেশগণ! তোমাদের সম্মুখে জ্বলন্ত দোজখের মহাশাস্তি রহিয়াছে; যদি তোমরা আমার ও খোদার বাণীর উপর আস্থা স্থাপন না কর, তবে তোমাদিগকে ওই শাস্তি ভোগ করিতে হইবে। তোমরা স্ব স্ব আত্মাকে উক্ত শাস্তি হইতে রক্ষা করো। ইহা শুনিয়া আবু লহব (হজরতের পিতার বৈমাত্রেয় ভ্রাতা, তাহার স্ত্রী আবু সুফিয়ানের ভগ্নী উম্মে জামিলা) রাগান্বিত হইয়া বলিল, ‘তাব্বান লাকা’–তোর ধ্বংস হউক। এই ঘটনার পর এই সুরা অবতীর্ণ হয়। (বোখারী) সুরা নসর্ এই সুরা মদিনা শরিফে অবতীর্ণ হয়; ইহাতে ৩টি আয়াত, ১৯টি শব্দ ও ৮১টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—হিজরি ষষ্ঠ সালে হজরত ছাহাবাগণসহ ‘ওমরা’ সম্পন্ন করার জন্য হোদায়বিয়া নামক স্থানে উপস্থিত হইলে কোরেশগণ তাঁহাদিগকে মক্কা শরিফে প্রবেশ করিতে বাধা প্রদান করে। সেই সময় কোরেশগণের সহিত হজরতের এই মর্মে এক সন্ধি হয় যে, একদল অপর দলের প্রতি কোনো প্রকার অত্যাচার করিতে পারিবে না। বনুবকর সম্প্রদায় কোরেশদের ও খোজা সম্প্রদায় হজরতের পক্ষভুক্ত হইল। কিছুকাল পর বনুবকরেরা কোরেশদের সহায়তায় উক্ত অঙ্গীকার ভঙ্গ করতঃ খোজাদলকে আক্রমণ করে। খোজারা হেরেম শরিফে আশ্রয় গ্রহণ করা সত্ত্বেও বনুবকরেরা তাহাদিগকে প্রহার করে। জনৈক খোজা-নেতা ও তাহাদের দলের কয়েকজন লোক মদিনা শরিফে হজরতের নিকট উপস্থিত হইয়া সাহায্য প্রার্থনা করেন। হজরত ছাহাবাগণকে অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হইতে আদেশ প্রদান করেন। পূর্বের অঙ্গীকার দৃঢ় ও শর্তের সময় বৃদ্ধি করার মানসে কোরেশগণ আবুসুফিয়ানকে মদিনা শরিফে প্রেরণ করেন। হজরত আলি, জোবায়ের প্রভৃতি ছাহাবার প্রেরিত পত্রবাহকের নিকট হইতে পত্র কাড়িয়া লন। দশম হিজরিতে দশ হাজার ছাহাবা-সহ মক্কা অভিমুখে হজরত যাত্রা করেন। আবুসুফিয়ানের ইসলাম গ্রহণ, হজরত আব্বাসের প্রার্থনায় তাহার মুক্তি, বহু সৈন্যের ভীতি, মক্কা বিজয়, অধিবাসীগণকে ক্ষমা, ১৫ দিবস তথায় অবস্থান ইত্যাদির আভাস ইহাতে প্রদান করা হইয়াছে। সুরা কাফেরুন এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ; ইহাতে ৬টি আয়াত, ২৭টি শব্দ ও ৯৯টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—ওমাইয়া, হারেছ, আ-স, অলিদ প্রভৃতি কোরেশগণ হজরত তাহাদের ধর্মমতের অনুসরণ করিলে তাহারাও হজরতের ধর্মমতের অনুসরণ করিবেন বলায় তিনি বলিলেন, আমি আল্লার নিকট আশ্রয় প্রার্থনা করি, আমি কখনও তাঁহার অংশীস্থাপন করিতে পারিব না। তাহারা বশ্যতা স্বীকার করে না অথচ হজরতের সহিত মিলিত হইতে চায়; তখন এই সুরা নাজেল হয়। সুরা কাওসার এই সুরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়; ইহাতে ৩টি আয়াত, ১০টি শব্দ ও ৩৭টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—এই সুরাটি আবু জহল, আবু লহব, আ-স ও আকাবার সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল। কথিত আছে, হজরতের পুত্র তাহের দেহত্যাগ করার পর আ-স নামীয় জনৈক ধর্মদ্রোহী হজরতের সহিত আলাপ করার পর নিজের দলের লোকদের প্রশ্নের উত্তরে বলিয়াছিল, আমি আব্তর নিঃসন্তান বা আঁটকুড়ের সহিত আলাপ করিয়াছি। উহা শ্রবণ করিয়া হজরত দুঃখিত হইয়া বলিয়াছিলেন যে, তাঁহার এন্তেকালের পর হয়তো তাঁহার নাম লোপ পাইবে। তাঁহার সান্ত্বনার জন্য এই সুরা অবতীর্ণ হয়। সুরা মাঊন মক্কা শরিফে এই সুরা অবতীর্ণ হয়; ইহাতে ৭টি আয়াত, ২৫টি শব্দ ও ১১৫টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—আবু জহল কোনো মুমূর্ষু ব্যক্তির সন্তানের তত্ত্বাবধানের ভার লইয়া উক্ত ব্যক্তির মৃত্যুর পর নিজেই বালকের পিতার ত্যাজ্য সম্পত্তি ভোগ করিতে থাকে, এবং বালকটিকে বিতাড়িত করিয়া দেয়। উক্ত বালক ক্ষুধার্ত ও বিবস্ত্র অবস্থায় হজরতের নিকট উপস্থিত হইয়া আবু জহলের অসদ্ব্যবহার ও অত্যাচার-কাহিনি প্রকাশ করে। হজরত আবু জহলের নিকট যাইয়া উহার প্রতিকারার্থে তাহাকে কেয়ামতের ভীতি প্রদর্শন করেন। আবু জহল কেয়ামতের প্রতি অসত্যারোপ করিতে থাকায় হজরত দুঃখিত মনে নিজ গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। আবু সুফিয়ান সম্মান লাভের ইচ্ছায় প্রতি সপ্তাহে দুইটি করিয়া উষ্ট্র জবেহ করিয়া সম্ভ্রান্ত কোরেশদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া খাওয়াইত। একদা জনৈক পিতৃহীন বালক আবু সুফিয়ানের বাড়িতে নিমন্ত্রণের দিন উপস্থিত হইয়া কিছু মাংস ভিক্ষা চাহিয়াছিল। উহাতে সে যষ্টির আঘাত করিয়া উক্ত বালককে বিতাড়িত করে; সেইজন্য এই সুরা নাজেল হয়। (এমাম রাজী।) কেহ কেহ বলেন– কেয়ামত অমান্যকারী পাপী আ-স কিংবা ধনশালী, অবাধ্য ও অহংকারী অলীদের সম্বন্ধে ইহা অবতীর্ণ হইয়াছিল। শেষার্ধ আবদুল্লা-বেনে-ওবাইয়া নামক জনৈক কপটাচারীর সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল বলিয়া ‘খাজেনে’ উল্লিখিত আছে। পরন্তু ধার্মিক বলিয়া পরিচিত যে সকল ব্যক্তির ব্যবহারে অধর্ম প্রকাশ পায় তাহাদের লোক-দেখানো কপটতার উদ্দেশ্যেই এই সুরা নাজেল হইয়াছে। সুরা কোরায়শ ইহা মক্কায় নাজেল হইয়াছে। এই সুরাতে ৪টি আয়াত, ১৭টি শব্দ ও ৭৯টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—করশ শব্দ হইতে কোরায়শ শব্দ উৎপন্ন হইয়াছে। ইহার আভিধানিক অর্থ—অর্থ সংগ্রহ করা বা উপজীবিকা সংগ্রহ করা। কোরায়েশগণ ব্যবসায় দ্বারা অর্থ বা উপজীবিকা সংগ্রহ করিতেন—তজ্জন্য তাঁহারা এই নামে অভিহিত হইতেন। এবনে আব্বাসের মতে, কোরায়েশ নামক এক প্রকার জলজন্তু সমুদ্রে বাস করে। উহারা সামুদ্রিক জন্তুদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা বৃহৎ। উহারা যে সামুদ্রিক জন্তুর নিকট উপস্থিত হয় তাহাকেই গ্রাস করে; কিন্তু অন্য কোনো জন্তু উহাদিগকে গ্রাস করিতে পারে না। আরব দেশের সর্বাপেক্ষা পরাক্রমশালী সম্প্রদায় কেলাবের পুত্র কোছাইয়ের বংশধরেরা এই নামে অভিহিত। তাহারা বাণিজ্যার্থে শীতকালে ইমন প্রদেশের দিকে ও গ্রীষ্মকালে শাম (সিরিয়া) দেশের দিকে যাইত। কাবাগৃহের রক্ষক ও অধিপতি বলিয়া উভয় দেশের নরপতিগণ তাহাদিগকে প্রচুর সম্মান করিত; আর তাহারাও বস্ত্র, খাদ্য ইত্যাদি আবশ্যকীয় বস্তুগুলি স্বদেশে আনয়ন করিত ও বাণিজ্যে বেশ লাভবান হইত। কানানার পুত্র নাজারকে কোরায়েশ নামে অভিহিত করা হইত। তৎপর তাহার বংশধরেরা উক্ত নামে অভিহিত হইতে থাকে। হজরত ও তাঁহার ৪ জন খলিফা এই বংশসম্ভূত। সুরা ফীল এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। আবরাহার দলের উপর জয়ী হওয়ায় আবিসিনিয়াবাসীদের সম্বন্ধে এই সুরা অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৫টি আয়াত, ২৪টি শব্দ ও ৯৪টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—ইমন প্রদেশের শাসনকর্তা আবরহা ঈর্ষার বশবর্তী হইয়া ইমনের ‘ছানয়া’ নামক স্থানে রত্নরাজি খচিত ‘কলিসা’ নামে একটি গির্জা প্রস্তুত করিয়া তথায় উপাসনার নিমিত্ত লোকদিগকে আহ্বান করেন। ধার্মিক লোকেরা তাঁহার আদেশ মানিতে রাজি না হওয়ায় তিনি কাবাগৃহ ধ্বংসের নিমিত্ত বহু সৈন্যসামন্ত ও ১৩টি হাতি (‘মামুদ’ সহ) প্রেরণ করেন। হজরতের পিতামহ আবদুল মোতালেব ‘মোগাম্মছ’ নামক স্থানে হান্নাতা নামক ব্যক্তির সহিত যাইয়া আবরাহার নিকট হাজির হন ও যথেষ্ট সম্মান পান এবং তাঁহার লুণ্ঠিত দুই শত উষ্ট্র ফেরত পাইবার দাবি জানান। আবরাহা কাবা ধ্বংসের বাসনা জ্ঞাপন করায় তিনি বলেন—আমি উটের মালিক, উট ফেরত চাই—কাবা গৃহের মালিক স্বয়ং আল্লাহ্, কাজেই তিনি উহা রক্ষা করিবেন। আরবের অপর যে-সকল নেতা তাঁহার সঙ্গে গিয়াছিলেন তাঁহারা মক্কার ধনসম্পদ বা চতুষ্পদ জন্তুসমূহের দুই-তৃতীয়াংশ আবরাহাকে দিতে চাওয়া সত্ত্বেও আবরহা কাবা ধ্বংসের সংকল্প ত্যাগ করিলেন না, আবদুল মোতালেবের উটগুলি ফেরত দিতে আদেশ দিলেন। আবরাহা যুদ্ধ ঘোষণা করিলেন। তখন কাবার মর্যাদা রক্ষার নিমিত্ত আল্লাহ্তালা দলে দলে পাখি প্রেরণ করিলেন। উহারা উপর হইতে কঙ্কর নিক্ষেপ করতঃ আবরাহার সমস্ত হস্তী ও সৈন্য বিনাশ করিয়া দিল। এই ঘটনার কিছুকাল পর হজরতের জন্ম হয়। কোরেশগণের উপর যে আল্লাহ্ মহা অনুগ্রহ প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহাই এই সুরায় বর্ণিত হইয়াছে। উক্ত অনুগ্রহ স্মরণ করিয়া আল্লার এবাদত করা কোরায়েশগণের কর্তব্য, এই উদ্দেশ্যে এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে। সুরা হুমাজাত এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্না হইয়াছে। ইহাতে ৯টি আয়াত, ৩৩টি শব্দ ও ২৩৫টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল –ধর্মদ্রোহী আখনাস, অলিদ, ওবাই, ওমাইয়া, জমি ও আ-স এর সাক্ষাতে হজরতকে ও তাহার সহচরগণকে বিদ্রুপ করিত, এবং অসাক্ষাতে তাঁহাদের অপবাদ প্রচার করিত। এই জন্য এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে। সুরা আস্র এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৩টি আয়াত, ১৪টি শব্দ ও ৭৪টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—একদা হজরত আবুবকর (রাঃ) তাঁহার পূর্ববন্ধু কালদার সঙ্গে বসিয়া আহার করিতেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে কালদা বলিল—আপনি দক্ষতা সহকারে বাণিজ্য করিয়া লাভবান হইয়া আসিতেছেন—বর্তমানে পৈতৃক ধর্ম (প্রতিমা-পূজা) পরিত্যাগে মহা ক্ষতিগ্রস্ত হইলেন। তদুত্তরে আবুবকর (রাঃ) বলিলেন—যে সত্য ধর্ম অবলম্বন ও সৎকার্য সম্পাদন করে, সে ক্ষতিগ্রস্ত হইতে পারে না। সেই সময় এই সুরা অবতীর্ণ হয়। এবনে আব্বাসের মতে, ইহা অলিদ, আ-স কিংবা আসওয়াদের সম্বন্ধে অবতীর্ণ হইয়াছিল। মোকাতেলের মতে, আবু লাহাব সম্বন্ধে ইহা অবতীর্ণ হইয়াছিল। সুরা তাকাসুর এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ৮টি আয়াত, ২৮টি শব্দ ও ১২৩টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—কোরেশ কুলের এক শাখার নাম বণি-আব্দ-বেনে মান্নাফ, অপর শাখার নাম বণি-সাহম। প্রত্যেক শ্রেণি অহংকারে মত্ত হইয়া বলিতে লাগিল—আমরা অর্থে, ঐশ্বর্যে, সম্ভ্রমে ও লোকসংখ্যায় শ্রেষ্ঠতর। এমনকী, প্রত্যেক দল স্বীয় গৌরব বর্ধনের নিমিত্ত আপন দলভুক্ত লোকদিগকে গণনা করিতে আরম্ভ করিল। এই গণনায় আব্দ-মান্নাফ বংশের লোক সংখ্যায় অধিক হইল। পরে জীবিত ও মৃত উভয় শ্রেণির লোক গণনা করায় বণি-সাহম দলের লোকসংখ্যা অধিক হইল। লোকসংখ্যা নিরূপণের নিমিত্ত তাহারা গোরস্থানে গিয়াছিল। সেই সময় এই সুরা নাজেল হয়। [মতান্তরে :- ইহুদিগণের নামে সংখ্যাধিক্য লইয়া কলহের সূত্রপাত হওয়ায় মদিনাবাসী বণি-হারেস ও বণি-হারেসা এই দুই দল পরস্পর ধনৈশ্বর্যের অহংকার করায় এই সুরা নাজেল হয়।—(এক্সির)] সুর ক্বারেয়াত এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ১১টি আয়াত, ৩৫টি শব্দ ও ১৬০টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—কেয়ামতের ভীতি প্রদর্শন ও ইসলামের বিজয়ের ইঙ্গিত করার জন্য এই সুরা নাজেল হয়। এমাম কাতাদা বলেন—একদা ইহুদিগণ বলিয়াছিল যে, আমরা বিপক্ষ দল অপেক্ষা সংখ্যায় অধিক; সেই সময়ে এই সুরা নাজেল হয়। এমাম এবনে কসিরের মতে, মদিনাবাসী বণি-হরেস ও বণি-হারেসা এই দুই দল ধনসম্পদের অহংকার করিয়াছিল, তজ্জন্য এই সুরা নাজেল হয়। সুরা আ-দিয়াত এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হইয়াছে। ইহাতে ১১টি আয়াত, ৪০টি শব্দ ও ১৭০টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—হজরত তাঁহার সহচর মোনজের-বেনে-আমরকে একদল অশ্বারোহীসহ ‘বণি-কানানা’ সম্প্রদায়কে আক্রমণ করিতে পাঠান এবং ফিরিয়া আসিবার দিন নির্দিষ্ট করিয়া দেন। পাথের এক স্থান জলপ্লাবিত থাকায় তাঁহাদের ফিরিয়া আসিতে বিলম্ব হয়। তখন কাফেরগণ উক্ত সৈন্য দল বিনষ্ট হইয়াছে বলিয়া মিথ্যা সংবাদ প্রচার করায় মুসলমানগণ দুঃখিত হয়। তাঁহাদিগকে সান্ত্বনা প্রদানের নিমিত্ত এই সুরা নাজেল হয়। সুরা জিলজাল এই সুরায় ৮টি আয়াত, ৩৭টি শব্দ ও ১৫৮টি অক্ষর আছে। হাক্কানী, হোসেনী, শাহ্ অলিউল্লাহ্, শাহ্ রফিউদ্দিন, শাহ্ আবদুল আজিজ প্রভৃতির মতে, এই সুরা মদিনা শরিফে নাজেল হইয়াছে। কবির বলেন—এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে (এবনে আব্বাস, কাতাদা)। কাশ্শাপ, বায়জাবী ও জালালাইন বলেন—এই সুরার অবতরণ-স্থান সম্বন্ধে মতভেদ দৃষ্ট হয়।—(বোখারী শরিফ, Part1, Vol.1.) শানে-নজুল—একদা হজরতের সঙ্গে আবুবকর (রাঃ) যখন কিছু খাদ্য গ্রহণ করিতেছিলেন, সেই সময় ৭/৮ আয়াত নাজেল হয়। তখন আবুবকর (রাঃ) আহার গ্রহণ ত্যাগ করিয়া হজরতকে জিজ্ঞাসা করিলেন, আমি কি এক বিন্দু কুকর্মের প্রতিফল প্রাপ্ত হইব? তদুত্তরে হজরত বলিয়াছিলেন, সংসারে তুমি যে কোনও সময়ে বিপদাপন্ন হও, উহা তোমার বিন্দু বিন্দু অসৎ কর্মের প্রতিফল; আর তোমার বিন্দু বিন্দু পুণ্যকে আল্লা তোমার জন্য সম্বলস্বরূপ রক্ষা করেন, পরকালে, ওই সকলের প্রতিদান আল্লা তোমাকে দিবেন। সামান্য সামান্য সৎকার্য আর সামান্য সামান্য পাপকার্য একত্রিত হইয়া পর্বততুল্য হইয়া যায়; অকিঞ্চিৎকর কার্যও বৃথা যায় না—এই শিক্ষা প্রচারার্থে উক্ত আয়াতদ্বয় নাজেল হয়। সুরা বাইয়েনাহ্ এই সুরায় ৮টি আয়াত, ৯৫টি শব্দ ও ৪১৩টি অক্ষর আছে। কবির, হাক্কানী, শাহ অলিউল্লাহ, ও শাহ্ রফিউদ্দিন বলেন—এই সুরা মদিনা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। কাশ্শাফ, বায়জাবী, জালালাইন ও হোসেনী বলেন, এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। শানে-নজুল—মদিনার ইহুদিগণ ও মক্কার অংশীবাদীগণ তৌরাতের প্রতিশ্রুত শেষ পয়গম্বরের প্রতীক্ষায় ছিল। শেষ পয়গম্বর আবির্ভাব হওয়া সত্ত্বেও তাহারা পাপকার্য হইতে বিরত হয় নাই—তজ্জন্য এই সুরা নাজেল হয়। সুরা কদর এই সুরায় ৫টি আয়াত, ৩০টি শব্দ ও ১১৫টি অক্ষর আছে। ইহা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। কাশ্শাফ বায়জাবী, জালালাইন ও হোসেনীর মতে, এই সুরা মদিনা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। শানে-নজুল—কোনো কথাপ্রসঙ্গে একদা হজরত উল্লেখ করেন যে, ইসরায়েল বংশীয় হজরত সমউন সহস্র মাস কাল দিবস রোজা রাখিতেন ও জেহাদ (ধর্মযুদ্ধ) করিতেন আর রাত্রি জাগিয়া নামাজ পড়িতেন। ইহা শুনিয়া তাঁহার আসহাবগণ বলিল—সাধারণত আমরা ৬০/৭০ বৎসর বাঁচিয়া থাকি; তন্মধ্যে কতকাংশ শৈশবাবস্থায়, কতকাংশ নিদ্রিতাবস্থায়, কতকাংশ পীড়িত ও শৈথিল্যাবস্থায় এবং কতকাংশ জীবিকা সংগ্রহ করিতে অতিবাহিত হয়; অবশিষ্টাংশে আমরা কতটুকু সৎকার্য করিতে সক্ষম হইব? উহাতে হজরত দুঃখিত হন। তখন এই সুরা নাজেল হয়। সুরা আলক এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ২৯টি আয়াত, ৭২টি শব্দ ও ২৯০টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—মক্কার অদূরে হেরা গিরি-গহ্বরে হজরত এবাদতে মশগুল হইতেন। জেব্রাইল হজরতের নিকট সর্বপ্রথম তথায় উপস্থিত হইয়া বলিলেন—‘আপনি পাঠ করুন।’ হজরত বলিলেন—‘আমি নিরক্ষর এবং পাঠ করিতে সমর্থ নহি।’ এইরূপ তিন প্রশ্নোত্তরের পর জেব্রাইল বলিলেন—‘আপনি সেই মহান খোদার নামে পাঠ করুন’ ইত্যাদি। (কবির, কাশ্শাফ, বায়জাবী) প্রথম পাঁচ আয়াত তখন নাজেল হয়। প্রথম ৫ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সুরা ফাতেহা ও তৎপর সুরা মোদ্দাস্সের অবতীর্ণ হয়। হজরত সেজদা করিতেছেন দেখিলে আবু জহল তাঁহার গ্রীবায় পদাঘাত ও তাঁহার মুখমণ্ডল মৃত্তিকায় প্রোথিত করিবে বলিয়া প্রতিবার শপথ করিয়াছিল। হজরতের নামাজ পড়িবার সময় কাছে উপস্থিত হইয়াও প্রতিজ্ঞা অনুরূপ কাজ করিতে সক্ষম হয় না। তখন ৬-১৪ আয়াত নাজেল হয়। সুরা তীন এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হইয়াছে। ইহাতে ৮টি আয়াত, ৩৪টি শব্দ ও ১৬৫টি অক্ষর আছে। শানে নজুল—১। তীন-আঞ্জির, জায়তুন-তৈল বৃক্ষ বিশেষ। উভয় নামে পরিচিত পর্বতে হজরত ইশার জন্ম ও নবুয়ত-প্রাপ্তি হয়। ২। সিনিনা—সিনাই পাহাড়; এ স্থানে হজরত মুসা ‘তওরত’ গ্রন্থ প্রাপ্ত হন। ৩। বালাদুন আমিন—‘শান্তিময় নগর’—এই বাক্যাংশ দ্বরা হজরত মোহাম্মদ মোস্তফার (দঃ) জন্মভূমি মক্কা নগরকে বুঝায়। উক্ত তিনটি পাক স্থানের নামি উপরোক্ত নবিগণের স্মরণার্থ আল্লাহ্তালা শপথ করিয়া মানবগণকে এই সাবধান-বাণী জানাইতেছেন যে, তিনি আদেশ-প্রদাতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ (আদেশ-প্রদাতা)। সুরা ইনশেরাহ্ এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হয়। ইহাতে ৮টি আয়াত, ২৭টি শব্দ ও ১০৩টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—খদিজা বিবির মৃত্যুর পর হজরত সাতিশয় মর্মাহত ও চিন্তাভারাক্রান্ত হইয়া পড়েন। তাঁহাকে উক্ত শোকে সান্ত্বনা দিবার জন্য এই সুরা নাজেল হয়। এবাদত-বন্দেগী ও কোরআনে তোমাকে উল্লেখ করিয়া এবং তোমার গুরুতর দায়িত্ব পরিপূর্ণ করিয়া দিয়া তোমাকে মহিমান্বিত করি নাই কি? ইত্যাদি শানে-নজুলের মর্ম।—(তফসীরে কবির।) সুরা দ্বোহা এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হয়। ইহাতে ১১টি আয়াত, ৪০টি শব্দ ও ১৬৬টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—হজরতের নিকট কোনো কারণে কয়েকদিন (কাহারও মতে ১০, কাহারও মতে ১৫, কাহারও মতে ৪০ দিন) অহি নাজেল না হওয়ায় কাফেরেরা বিদ্রুপ করিয়া বলিতেছিল—মোহাম্মদকে (দঃ) তাঁর আল্লা পরিত্যাগ করিয়াছেন। ইহা শ্রবণ করিয়া হজরত দুঃখে মর্মাহত হন, তখন এই সুরা নাজেল হয়। সুরা লায়্ল্ এই সুরা মক্কাতে নাজেল হয়। ইহাতে ২১টি আয়াত, ৭১টি শব্দ ও ৩১৪টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—আবুবকর (রাঃ) ও ২য় খালাফের পুত্র ওমাইয়া মক্কায় ধনাঢ্য ও সম্ভ্রান্ত সমাজ-নেতা ছিলেন। ওমাইয়া ১২টি কিঙ্কর দ্বারা নানা উপায়ে বিপুল অর্থ উপার্জন করিয়াছিলেন। পরকালের জন্য কেন তিনি দান করেন না? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলিতেন—প্রয়াসী বিপুল অর্থ সম্পদ থাকিতে কল্পিত বেহেশ্তের সম্পদ লাভের আশায় আমি নাই। ইনিই হজরত বেলালের মনিব ছিলেন। ওমাইয়ার গৃহে রাত্রে ক্রন্দনের শব্দ শ্রবণ করিয়া হজরত আবুবকর স্বীয় ক্রীতদাস নাস্তাশ ও ৪০টি স্বর্ণমুদ্রার বিনিময়ে বেলালকে ক্রয় করিয়া হজরতের সামনে নিয়া তাঁহাকে মুক্তি দান করেন। অতএব, আবুবকর ও ওমাইয়া সম্বন্ধে এই সুরা নাজেল হয়। সুরা শাম্স্ এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ১৫টি আয়াত, ৫৬টি শব্দ ও ২৫৪টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—কোরআন শরিফে সাধারণত আধিভৌতিক, আধ্যাত্মিক ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের যুক্তির সাহায্যে কোনো একটা সত্য প্রতিষ্ঠা ও সপ্রমাণ করার বিষয় দেখিতে পাওয়া যায়। এই সুরায় সূর্য, চন্দ্র ও দিবারাত্রি প্রভৃতির উল্লেখ দ্বারা উহাদের তারতম্য বুঝানো হইয়াছে; আর কোন কার্য দ্বারা মানুষ আত্মাকে পবিত্র রাখিয়া জীবন সার্থক করিতে পারে এবং কোন কার্য করিলে মানুষের আত্মা কলুষিত ও জীবন ব্যর্থ হয় তাহার দৃষ্টান্ত দেওয়া হইয়াছে। ‘সমুদ’ জাতির এই ঘটনার উল্লেখ করিয়া—‘খোদাতায়ালা যাহাকে ইচ্ছা হেদায়েত করেন, যাহাকে ইচ্ছা গোমরাহ্ করেন’—এই উক্তি উপরোক্ত সুরা দ্বারা খণ্ডন করা হইয়াছে। সুরা বালাদ্ এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হইয়াছে। ইহাতে ২০টি আয়াত, ৮২টি শব্দ ও ৩৪৭টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—কালদা নামক বলিষ্ঠ কাফেরকে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) ইসলাম গ্রহণ করিতে বলায় সে অবজ্ঞাভরে বলিয়াছিল যে, দোজখের ১৯জন ফেরেশতাকে সে একা বাম হস্তে অবরোধ করিতে পারিবে; বেহেশ্তের বাগিচা, নহর ও মণিকাঞ্চনের মূল্য তাহার বিবাহাদি উৎসবে ব্যয়িত অর্থের তুল্য হইতে পারে না। তখন এই সুরা নাজেল হয়। সুরা ফজর এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৩০টি আয়াত, ১৩৭টি শব্দ ও ৫৮৫টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—এক সময় কাফেররা বলিতে লাগিল যে, মানুষের ভালোমন্দ কার্যের প্রতিফল প্রদান করা আল্লার অভিপ্রেত নহে। যদি তিনি পাপীর প্রতি অসন্তুষ্ট ও পুণ্যবানের প্রতি সন্তুষ্ট হইতেন তবে কেয়ামতের প্রতীক্ষা না করিয়া ইহজগতেই কেন সৎ লোকদিগকে সম্পদশালী ও অসৎ লোকদিগকে বিপদগ্রস্ত করেন না? পরলোক মিথ্যা ইত্যাদি। তখন এই সুরা নাজেল হয়। সুরা গ্বাশিয়া এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৬টি আয়াত, ৯৩টি শব্দ ও ৩৮৪টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—মানুষ পরজীবনের কর্মফল ভোগ করিবে, আরবেরা ইহা বিশ্বাস করিত না। তাহারা বলিত, মানুষ একবার মরিয়া মাটি হইয়া গেলে পুনর্জীবন লাভ করিবে কী করিয়া? এই সুরায় মেঘমালার দৃষ্টান্ত দ্বারা বুঝানো হইয়াছে যে, আল্লার কুদ্রতে সব কিছু সম্ভব, অনন্ত শক্তিময় আল্লার পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়। তিনি মানুষকে পুনর্জীবন দান করিয়া এই জীবনের কর্মফল ভোগ করাইবেন। মানুষ এই জীবনে দুষ্কর্ম করিলে পরজীবনে তাহার সাজা পাইবে, আর এই জীবনে সৎকর্ম করিলে পরজীবনে তাহার পুরস্কার পাইবে। মানুষের কোনো কর্মই বৃথা হইবে না, ইহা বুঝাইবার জন্যই এই সুরা নাজেল হইয়াছে। সুরা আ-লা এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ১৯টি আয়াত, ৭২টি শব্দ ও ২৯৯টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—যখন হজরতের প্রতি সুদীর্ঘ সুরাসমূহ নাজেল হইতে থাকে এবং তিনি অসংখ্য তত্ত্বজ্ঞান লাভ করিতে থাকেন, তখন তাঁহার মনে এই চিন্তা উপস্থিত হয় যে, আমি কোনো শিক্ষকের নিকট লেখাপড়া শিখি নাই, এমতাবস্থায় এত অধিক সংখ্যক শব্দ ও সূক্ষ্ম মর্ম আয়ত্ত করা ও স্মরণ রাখা সম্ভব হইবে না, হয়তো ইহার অধিকাংশ বিলুপ্ত হইয়া যাইতে পারে। তাঁহাকে সান্ত্বনা প্রদানার্থ এই সুরা অবতীর্ণ হয়—‘খোদাই আপনার শিক্ষাদাতা, আপনি উহা ভুলিবার কল্পনাও করিবেন না।’ সুরা তারেক এই সুরা মক্কা শরিফে নাজেল হয়। ইহাতে ১৭টি আয়াত, ৬১টি শব্দ ও ২৫৪টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—একদা রাত্রিতে হজরতের গৃহে তাঁহার পিতৃব্য আবু তালেব উপস্থিত হইলে পর, তাঁহার সামনে আহারের নিমিত্ত রুটি ও দুগ্ধ হাজির করা হয়। তাঁহারা উভয়ে যখন খাদ্য গ্রহণে রত তখন একটি উল্কাপিণ্ডের জ্যোতিতে ওই গৃহ উদ্ভাসিত হইলে ওই জ্যোতিতে আবু তালেবের চোখের জ্যোতি ক্ষীণ হইয়া গেল। ব্যস্ততা-সহকারে ভোজন ত্যাগ করিয়া উঠিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—ইহা কী? হজরত বলিলেন—শয়তানেরা যখন আশমানের গুপ্ত তত্ত্ব অনুসন্ধান করিবার নিমিত্ত উড্ডীয়মান হয়, তখন ফেরেশতারা উল্কাপিণ্ড নিক্ষেপ করিয়া উহাদিগকে বিতাড়িত করে। আবু তালেব বিস্ময়ান্বিত হইয়া নিস্তব্ধ হইলেন। তখন এই সুরা নাজেল হয়। সুরা বুরুজ এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ২২টি আয়াত, ১০৯টি শব্দ ও ৪৭৫ টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—মক্কার পৌত্তলিকেরা মুসলমানগণকে ইসলাম গ্রহণ করার দরুন নানা প্রকার উৎপীড়ন করিত। হজরতের নিকট মুসলমানগণ অভিযোগ করায় তিনি উত্তরে বলিয়াছিলেন যে, এক সময় তাহাদের দুর্ব্যবহারের প্রতিশোধ গ্রহণ করিতে খোদা তোমাদিগকে সক্ষম করিবেন। এ কথা শ্রবণ করিয়া কাফেররা বলিতে লাগিল—এরূপ দুর্বল, অপমানিত ও অর্থহীন লোকেরা কীরূপে প্রতিশোধ লইতে সক্ষম হইবে? খোদার ইচ্ছাতেই আমরা সম্মানিত আর তাহারা হেয় ও লাঞ্ছিত। কাফেরদের উক্ত কথার প্রত্যুত্তরস্বরূপ ওই সময় এই সুরা অবতীর্ণ হয়। অগ্নিকুণ্ড স্থাপয়িতাদের পরিণাম বর্ণনা করিয়া ইসলাম ধর্মাবলম্বীদিগকে ইহাতে সান্ত্বনা প্রদান করা হইয়াছে।—(আজিজী)। সুরা ইনশিকাক এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ২৫টি আয়াত, ১০৮টি শব্দ ও ৪৪৮টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—কেয়ামতের সময় মানুষের যে ভীষণ অবস্থা হইবে তাহার বর্ণনা ও পুনর্জীবন লাভের কথা এই সুরায় প্রকটিত হইয়াছে। কেয়ামত ও পুনর্জীবন লাভের কথা ভাবিয়া মানুষ যাহাতে সৎকর্ম সম্পাদন করে এই উদ্দেশ্যেই এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে। সুরা তাৎফিফ এই সুরা মক্কায় কি মদিনায় নাজেল হয় এ-সম্বন্ধে মতভেদ দৃষ্ট হয়। ইহাতে ৩৬টি আয়াত, ১৭২টি শব্দ ও ৭৫৮টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—হজরত মদিনায় পদার্পণ করিয়া দেখিলেন যে, উক্ত স্থানের অধিবাসীগণ পরিমাণ ও ওজনে কম-বেশি করিয়া থাকে, তখন এই সুরা নাজেল হয়। মক্কায় এই সুরা প্রথম নাজেল হইয়াছিল। হজরত মদিনায় যাওয়ার পর সেখানে ইহা পাঠ করিয়া শুনাইয়াদিলেন। সুরা ইনফিতার এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ১৯টি আয়াত, ৮০ টি শব্দ ও ৩৩৪টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল –কেয়ামতের ভীষণ অবস্থার বর্ণনা ও মানুষকে যে তাহার কর্মফল নিশ্চয়ই ভোগ করিতে হইবে তাহা এই সুরার প্রতিপাদ্য বিষয়। পরজীবনে সুফল পাইবার জন্য মানুষ যেন সৎকর্ম করে আর কুকর্মের ফল পরজীবনে যন্ত্রণাদায়ক হইবে ভাবিয়া যেন (এ জীবনে) কুকর্ম হইতে বিরত থাকে —এই উদ্দেশ্যেই এই সুরা নাজেল হইয়াছে। সুরা তকভীর এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ২৯টি আয়াত, ১০৪ টি শব্দ ও ৪৩৬টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল –কেয়ামত, পরকাল ও কর্মফল ভোগের কথা যখন হজরত মোহাম্মদ (দঃ) বলিতেন তখন মক্কাবাসীরা তাঁহাকে পাগল বলিত। কেয়ামতের ভীষণ ধ্বংসলীলা ও আল্লার শক্তির বর্ণনা দ্বারা তাঁহার প্রতি নির্ভরশীল হইয়া সৎকর্ম করিবার জন্য তাকিদ দিবার নিমিত্ত এই সুরা নাজেল হয়। সুরা আবাসা এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৩২টি আয়াত, ১৩৩ টি শব্দ ও ৫৫৩টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—একদা হজরত কোরেশ সম্প্রদায়ের ওৎবা, আবুজাহেল, আব্বাস প্রভৃতি বিশিষ্ট ব্যক্তিগণকে ইসলামের দিকে এই আশায় আহ্বান করিতেছিলেন যে, তাহারা ইসলাম গ্রহণ করিলে বহু লোক ইসলাম ধর্মগ্রহণ করিতে পারে। সেই সময় আবদুল্লাহ-এবনে-ওম্মে মকতুম নামক জনৈক অন্ধ লোক তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া তাঁহাকে কোরান শিক্ষা দিবার জন্য হজরতকে তাঁহার দিকে অগ্রসর হইতে বলে। সে হজরতের কথোপকথনে বাধা প্রদান করিতে আসিয়াছে ভাবিয়া হজরত মুখ বিমর্ষ করিয়াছিলেন। তখন এই সুরা নাজেল হয়। সুরা নাজেয়াত এই সুরা মক্কায় অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৪৬টি আয়াত, ১৮১টি শব্দ ও ৮৯১টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—অনন্ত শক্তিময় আল্লার শক্তির কথা আর পরকাল ও পুনর্জীবন প্রভৃতি বর্ণনা দ্বারা মানুষকে সাবধান করিয়া দেওয়া হইয়াছে,—মানুষ যেন নিজের মনকে নীচ প্রবৃত্তি হইতে নিবৃত্ত রাখে এবং ক্ষণস্থায়ী পার্থিব জীবনের সুখ-লালসার নিমিত্ত যেন পরকালের অনন্ত জীবনের অনন্ত সুখের পথ বিনষ্ট না করে। পরকালের প্রতি লক্ষ রাখার ইঙ্গিত দিবার জন্যই এই সুরা অবতীর্ণ হইয়াছে। সুরা নাবা এই সুরা মক্কা শরিফে অবতীর্ণ হয়। ইহাতে ৪০টি আয়াত, ১৭৪টি শব্দ ও ৮০১টি অক্ষর আছে। শানে-নজুল—হজরত প্রথম যে সময়ে লোকদিগকে ইসলামের দিকে আহ্বান করিয়া কোরান শুনাইতেন ও কেয়ামতের ভীতিপ্রদ সংবাদ বর্ণনা করিতেন সেই সময়ে বিধর্মীরা তাঁহার প্রেরিত তত্ত্ব, কোরান ও কেয়ামত সম্বন্ধে তর্ক-বিতর্ক করিত, আর একে অপরের নিকট ওই সকল বিষয় সম্বন্ধে নানারূপ প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিত। তখন এই সুরা নাজেল হয়।