ভূমিকা নিজের লেখা থেকে বাছাই করা খুব শক্ত কাজ। এর আগে আমার যে-কটি নির্বাচিত সংগ্রহ বেরিয়েছে, তার সবগুলিই নির্বাচন করে দিয়েছেন আমার কোনো কোনো অনুজ বন্ধু, আমি কোনো রকম পক্ষপাতিত্ব দেখাইনি। আমি কবিতা লিখতে লিখতে গদ্যের জগতে এসেছিলাম। কবিতা রচনার ফাঁকে ফাঁকে দুটি একটি ছোটোগল্প লিখে গদ্যের সীমানায় আমার প্রথম পদক্ষেপ। আমাদের অল্প বয়েসে বাংলায় উপন্যাসের চেয়েও ছোটোগল্পে বেশি রমরমা ছিল, পত্র-পত্রিকায় ছোটো- গল্পের সমাদর ছিল। ‘দেশ' পত্রিকায় শারদীয় সংখ্যায় একটিও উপন্যাস ছাপা হত না, সমস্ত প্রখ্যাত লেখকরাই মন প্রাণ দিয়ে ছোটোগল্প লিখতেন। আজও বাংলা ছোটোগল্প নিয়ে বিশ্বসাহিত্যে গর্ব করা যায়। নিজের রচনা নির্বাচন করতে গেলে সেগুলি আবার পড়তে হয়, পড়তে পড়তে নিজের দুর্বলতাগুলি চোখে পড়ে। মনে হয়, সব গল্পই আবার নতুন করে লেখা উচিত, কিন্তু তা তো সম্ভব নয়! আমি নিজের লেখার ভক্ত নই একেবারেই। আমার কোনো লেখাই আমার প্রিয় নয়। তবে কোনো কোনো লেখার সঙ্গে কিছুটা মায়া জড়িয়ে আছে, একথা ঠিক। কোনো বিশেষ গল্পটি লেখার সময়টা মনে পড়ে, গল্পের পরিবেশ ও বাস্তব চরিত্রগুলির কথা চোখে ভাসে। একেবারে বানানো কোনো গল্প আমি লিখতে পারি না, নিজের জীবনের কিছু না কিছু অংশ তাতে মিশে থাকে, সুতরাং এই সংকলনের গল্পগুলিকে আমার টুকরো টুকরো জীবন কাহিনীও বলা যায় ।
বিশ শতকের শেষাংশে জন্ম নেওয়া সব্যসাচী একজন বাঙ্গালি সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। একাধারে কবি, ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, সম্পাদক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট- এমন বহু পরিচয়ে সাহিত্যের অগণিত ক্ষেত্রে তিনি রেখেছেন তাঁর সুকুমার ছাপ। নীললোহিত, সনাতন পাঠক কিংবা কখনো নীল উপাধ্যায় ছদ্মনামে প্রকাশিত হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই সমূহ। অধুনা বাংলাদেশের মাদারীপুর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন ৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪। কিন্তু মাত্র চার বছর বয়সেই স্কুল শিক্ষক বাবার হাত ধরে সপরিবারে পাড়ি দিয়েছিলেন কলকাতায়। ১৯৫৩ সালে সাহিত্যে বিচরণ শুরু হয় কৃত্তিবাস নামের কাব্যপত্রিকার সম্পাদনার মধ্য দিয়ে। ১৯৫৮ সালে প্রকাশ পায় প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর বই মানেই পাঠকের কাছে আধুনিকতা আর রোমান্টিকতার মেলবন্ধন। তাঁর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি কবিতার বই হলো ‘আমি কী রকম ভাবে বেঁচে আছি’, ‘যুগলবন্দী’ (শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে), ‘হঠাৎ নীরার জন্য’, ‘রাত্রির রঁদেভূ’ ইত্যাদি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বই সমগ্র ‘পূর্ব-পশ্চিম’, ‘সেইসময়’ এবং ‘প্রথম আলো’ তাঁকে এপার, ওপার আর সারাবিশ্বের বাঙালির কাছে করেছে স্মরণীয়। ‘কাকাবাবু-সন্তু’ জুটির গোয়েন্দা সিরিজ শিশুসাহিত্যে তাকে এনে দিয়েছিলো অনন্য পাঠকপ্রিয়তা। তাঁরই উপন্যাস অবলম্বনে কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায় পরিচালনা করেছিলেন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ এবং ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’র মতো চলচ্চিত্র। পাঠক সমাদৃত ভ্রমণকাহিনী ‘ছবির দেশে কবিতার দেশে’ কিংবা আত্মজীবনীমূলক ‘অর্ধেক জীবন বই’তে সাহিত্যগুণে তুলে ধরেছিলেন নিজেরই জীবনের গল্প। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত চার দশকে তিনি পরিচিত ছিলেন জীবনানন্দ পরবর্তী পর্যায়ের অন্যতম প্রধান কবি এবং বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব হিসেবে।