সময়কাল ১৯০৯, সদ্য এফ এ পাশ করে গ্রামে এসেছে শঙ্কর। বাবার অসুখ আর সংসারের দারিদ্রের মাঝে মায়ের অনুরোধ পাটকলে চাকরি নেয়ার জন্য। ফুটবলের নামকরা সেন্টার ফরওয়ার্ড, জেলার হাই জাম্প চ্যাম্পিয়ন, নামজাদা সাতারু শঙ্করকে হতে হবে পাটকলের বাবু? না, স্বপ্নবাজদের স্বপ্ন কখনো পুরোপুরি শেষ হয়ে যায় না। ঘটনাক্রমে কিংবা সৌভাগ্যক্রমে শঙ্করের চাকরি জুটে রহস্য, অ্যাডভেঞ্চার আর রোমাঞ্চের দেশ আফ্রিকার উইগান্ডার রেলওয়েতে। আর সেই চাকরি জীবনেই ঘটতে থাকে যতসব লোমহর্ষক ঘটনা! সেই লোমহর্ষক গল্পের শুরু হয় আফ্রিকার অদম্য সিংহের নরমাংস ভক্ষনের ভীতিকর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। শঙ্করের কর্মস্থল থেকে এক এক করে অনেক মানুষকেই ধরে নিয়ে যেতে থাকে নরমাংস খেকো সিংহ। এরপর বদলি হয়ে এক ছোট্ট স্টেশনে স্টেশন মাস্টার হিসেবে যোগ দেয় সে। স্টেশন ঘরটা খুব ছোট, প্ল্যাটফর্ম আর স্টেশন ঘরের আশপাশ কাঁটা তারের বেড়া দিয়ে ঘেরা। আগের জায়গার তুলনায় এই জায়গাটা অনেক নিরাপদ। কিন্তু আসলেই কি নিরপদ? না, মোটেই নিরাপদ না! কারন এবার সিংহের সাথে যোগ হল সাপের উপদ্রব। তাও যেনতেন সাপ না- আফ্রিকান কালো মাম্বা। ভাবুনতো, অন্ধকার মাঝ রাতে আপনার বিছানার পাশে উদ্যত ফণা তুলে দাড়িয়ে আছে হিংস্রতম ব্ল্যাক মাম্বা! যেটার প্রতি ছোবলে ১৫০০ মিলিগ্রাম তীব্র বিষ শিকারের শরীরে ঢুকিয়ে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে। একসময় শঙ্করের দেখা হয় ডিয়েগো আলভারেজ এর সাথে। লাল দাড়ি আর বড় বড় চোখের এ মানুষটি ১৯৮৮/৮৯ সালের দিকে কেপ কলোনির উত্তর পাহাড়ের জঙ্গলে খুজে বেরিয়েছেন সোনার খনির সন্ধানে। একসময় খনির সন্ধান পেয়েও তা আর জয় করতে পারেন নি। তাই আবার বেরিয়েছেন নতুন করে। শঙ্কর কে সহযাত্রী হওয়ার প্রস্তাব করে সে, শঙ্করও রাজি হয় সাথে সাথে। গল্পের মূল কাহিনির শুরু এখান থেকেই। এরপর রুদ্ধশ্বাস অভিযান, লোমহর্ষক ঘটনাক্রম, কষ্ট, সাহস, বীরত্ব আর বন্ধুত্বের নানা উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাসের কাহিনী!
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।