রামায়ণ বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন মহাকাব্য। প্রাচীন ভারতের আর্থসামাজিক অবস্থা এই মহাকাব্যে ধরা পড়েছে। রামায়ণ আমাদের সত্য ও কল্যাণের পথে চলতে শেখায়, অধর্মের পথ পরিহার করে ধর্মের পথে জীবনযাপনের কথা বলে। রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, ভরত, হনুমান, রাজা দশরথ, কৌশল্যা, শত্রুঘ্ন, বিভীষণ, মন্দোদরীসহ অসংখ্য চরিত্র রয়েছে রামায়ণে। কেবল মানুষই নয়, বানর হনুমান, জটায়ুসহ অনেক পশুপাখি এখানে মানুষের ভাষায় কথা বলে, মানুষের কল্যাণে নিজেদের নিবেদন করে। মানুষ, রাক্ষস, দেবতা ও পশুপাখির নানা কাজে-কর্মে কিশোরমন নিশ্চয়ই আন্দোলিত হবে। রামায়ণে যে ভারতবর্ষের দেখা মিলবে, তা এক স্বপ্ন ও ছবির দেশ। উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী শিশু-কিশোরদের স্বপ্ন-কল্পনার জগৎকে মিথপুরাণের বিপুল ভূখণ্ডের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তাই ‘ছেলেদের রামায়ণ’ একান্তভাবেই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর নিজস্ব সৃষ্টি। আদিকবি ঋষি বাল্মীকির কাছ থেকে তিনি যা গ্রহণ করেছেন, তা উপেন্দ্রকিশোরের কল্পনাপ্রতিভার ছোঁয়ায় নতুন রূপ ও মাত্রা পেয়েছে। এই নতুনত্বের মন্ত্রেই রামায়ণ সব যুগের, সব বয়সী পাঠকের নিজস্ব শিল্পসম্পদ হয়ে ওঠে। আদিকাণ্ড, অযোদ্ধাকাণ্ড, আরণ্যকাণ্ড, কিষ্কিন্ধ্যাকাণ্ড, সুন্দরকাণ্ড, লঙ্কাকাণ্ড— সবখানেই কিশোরমন অবাধে ঘুরে বেড়াতে পারে। নানা ঘটনা-দুর্ঘটনার ভাঁজ খুলে শিশু-কিশোররা সামনে এগিয়ে যেতে শেখে। বাস্তববোধ ও কাণ্ডজ্ঞানের বাইরেও যে জ্ঞানের বিশাল ভান্ডার রয়েছে, রামায়ণের চরিত্রসমূহ তা আমাদের উপলব্ধি করতে শেখায়।
উপেন্দ্রকিশোরের জন্ম ১২৭০ বঙ্গাব্দের ২৭শে বৈশাখ (১৮৬৩ সালের ১০ই মে) ময়মনসিংহ জেলার মসূয়া গ্রামে, যা অধুনা বাংলাদেশে অবস্থিত। তাঁর পিতা কালিনাথ রায় ছিলেন সুদর্শন ও আরবি, ফার্সি ও সংস্কৃতে সুপণ্ডিত। তাঁর ডাকনাম ছিল শ্যামসুন্দর মুন্সী। উপেন্দ্রকিশোর শ্যামসুন্দরের আটটি সন্তানের মধ্যে তৃতীয় পুত্রসন্তান। তাঁর পৈতৃক নাম ছিল কামদারঞ্জন রায়। পাঁচ বছরেরও কম বয়সে তাঁর পিতার অপুত্রক আত্মীয় জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী তাঁকে দত্তক নেন ও নতুন নাম দেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। মেধাবী ছাত্র বলে পড়াশোনায় ভাল ফল করলেও ছোটোবেলা থেকেই উপেন্দ্রকিশোরের পড়াশোনার থেকে বেশি অনুরাগ ছিল বাঁশী, বেহালা ও সঙ্গীতের প্রতি। ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে উপেন্দ্রকিশোর প্রবেশিকা পরীক্ষা উত্তীর্ণ হয়ে বৃত্তি পান। তারপর কলকাতায় এসে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। ১৯১৫ সালের ২০শে ডিসেম্বর মাত্র বাহান্ন বছর বয়সে উপেন্দ্রকিশোর পরলোক গমন করেন।