মাঘ মাসে মকর—সংক্রান্তি সাগর—দ্বীপে প্রতি বৎসরই একটি খুব বড় রকমের মেলা বসিয়ে থাকে। মকর—সংক্রান্তিতে গঙ্গাসাগর—স্নান করিতে তখন নানা দেশের লোক আসিয়া জড়ো হয়। এই স্থানে সমুদ্রের গঙ্গার মিলন হইয়াছে, এইজন্য ইহা একটি তীর্থস্থান। প্রতি বৎসর হাজার হাজার লোক বাঙ্গলা, বিহার, উড়িষ্যা এবং নেপাল ও পাঞ্জাব প্রভৃতির দূর দেশ হইতেও এইখানে এই যোগ উপলক্ষে আসিয়া থাকে। বহু সাধু—সন্ন্যাসীরও সমাগম হয় এবং মেলায় নানা দেশ হইতে ব্যবসায়ী লোক আসিয়া উপস্থিত হয়। সমুদ্রতীরে বিস্তীর্ণ বালুকারাশির উপর এই বৃহৎ মেলাটি বসিয়া থাকে। তীর্থের কাজে তিন দিনের বেশি লাগে না বটে, কিন্তু মেলাটি চলে অনেক দিন। যাত্রীরা ভোরে উঠিয়া সাগরে স্নান করে; তারপর পঞ্চরত্ন দিয়া সাগরের পূজা করিয়া কপিল মুনির মন্দিরে গিয়া মুনির প্রতিমূর্তি দর্শন করে এবং সেখানেও পূজা দেয়। মন্দিরের বাহিরে একটি বটগাছ আছে, তাহার তলায় রাম এবং হনুমানের মূর্তি এবং কপিল মুনিরও একটি মূর্তি দেখিতে পাওয়া যায়। মন্দিরের পিছনে একটি কুণ্ডে আছে, তাহার নাম সীতা—কুণ্ডে। যাত্রীরা পা াদিগকে পয়সা দিয়া এই কুে র এক বিন্দু জল প্রত্যেকেই পান করিয়া থাকে। কপিল মুনির মন্দিরের ভিতর যাইতেও প্রত্যেক যাত্রীকে চারি আনা করিয়া দিতে হয়। পূর্বেই বলিয়াছি, সমুদ্রতীরে বিস্তীর্ণ বালুকারাশির উপর এই মেলাটি বসিয়া থাকে। মেলার জন্য যে সমস্ত কুঁড়েঘর তোলা হয়, তাহা ছাড়া কোনো ঘরবাড়ি এখানে নাই; অন্তত আমরা যে সময়ের কথা লিখিতেছি, সে সময়ে দেখি নাই। সুতরাং নৌকা ভিন্ন অন্য কোনো আশ্রয় যাত্রীদিগের ছিল না। তখন স্টিমার ছিল না, যাত্রীদিগকে নৌকা করিয়াই গঙ্গাসাগরে যাইতে হইত। কিন্তু সেই তীর্থস্থানে নৌকায় বাস করা অপেক্ষা, সেই অনাবৃত বালুকারাশির উপর শয়ন করিয়া রাত্রিযাপন করায় বেশি পূণ্য বলিয়া অনেকে তাহাই করিত! তীর্থস্থানে অনেকে যেমন পুণ্য সঞ্চয় করিতে যায়, তেমনি অনেকে আবার কুমতলবেও গিয়া থাকে। একদিকে সাধু—সন্ন্যাসীরা আসেন, অন্যদিকে তেমনি চোর—ডাকাতেরও অভাব থাকে না। আমরা যে সময়ের কথা লিখিতেছি, সেসময় দেশে চোর—ডাকাতের অত্যন্ত উপদ্রব ছিল। তখন আমার বয়স বড় বেশি নয়। আমি দাদামহাশয়ের সহিত গঙ্গাসাগর গিয়াছিলাম। দাদামহাশয় সাগরে গিয়াছিলেন পুণ্যস্নানে; আমি গিয়াছিলাম মেলা দেখিতে। বাড়ির কাহারও ইচ্ছা ছিল না, যে আমি যাই এবং দাদামহাশয়ও আমাকে প্রথমটা সঙ্গে লইয়া যাইতে রাজি হন নাই। কিন্তু আমি জেদ ধরিয়া বসিলাম যাইবই। জানিতাম, আমার আব্দার কখনই অপূর্ণ থাকে না। যখনই যে আব্দার করিতাম, তাহা যতই কেন অসঙ্গত হউক না, যতই কেন অসম্ভব হউক না, তাহা অপূর্ণ থাকিত না। ইহার ফল এই দাঁড়াইয়াছিল যে, ন্যায্য আব্দার ছাড়িয়া ক্রমে আমি নানা প্রকার অন্যায় আব্দার করিতে সাহসী হইয়াছিলাম।
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পথিকৃৎ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বেশ কিছু কালজয়ী উপন্যাস রচনার মাধ্যমে জয় করে নিয়েছেন বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের হৃদয়। শুধু উপন্যাসই নয়, এর পাশাপাশি তিনি রচনা করেছেন বিভিন্ন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনী, দিনলিপি ইত্যাদি। প্রখ্যাত এই সাহিত্যিক ১৮৯৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন, তবে তাঁর পৈতৃক নিবাস ছিল যশোর জেলায়। অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র হিসেবে তিনি শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন, যার প্রমাণ পাওয়া যায় তাঁর প্রথম বিভাগে এনট্রান্স ও আইএ পাশ করার মাধ্যমে। এমনকি তিনি কলকাতার রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বিএ পাশ করেন। সাহিত্য রচনার পাশাপশি তিনি শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমূহ এর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো 'পথের পাঁচালী', যা দেশ ছাড়িয়ে বিদেশের মাটিতেও ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করেছে বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হওয়ার মাধ্যমে। এই উপন্যাস অবলম্বনে চলচ্চিত্র নির্মাণ করে প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায় অর্জন করেছেন অশেষ সম্মাননা। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই এর মধ্যে আরো উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো 'আরণ্যক', 'অপরাজিত', 'ইছামতি', 'আদর্শ হিন্দু হোটেল', 'দেবযান' ইত্যাদি উপন্যাস, এবং 'মৌরীফুল', 'কিন্নর দল', 'মেঘমল্লার' ইত্যাদি গল্পসংকলন। ১০ খণ্ডে সমাপ্ত ‘বিভূতি রচনাবলী’ হলো বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর বই সমগ্র, যেখানে প্রায় সাড়ে ছ’হাজার পৃষ্ঠায় স্থান পেয়েছে তার যাবতীয় রচনাবলী। খ্যাতিমান এই সাহিত্যিক ১৯৫০ সালের ১ নভেম্বর বিহারের ঘাটশিলায় মৃত্যুবরণ করেন। সাহিত্যে অসামান্য অবদানের জন্য তিনি মরণোত্তর 'রবীন্দ্র পুরস্কারে' ভূষিত হন।