কড়ি ও কোমলে গড়ে-ওঠা কবি মিনার মনসুরের কাব্যজগতের যে-দ্বৈত চেতনা, তাঁর গদ্যবই যেন তারই আরেকরকম উৎসারণ। কালান্তরে কবির মুখ ও মুখোশ বইয়ে তিনি একই সঙ্গে গ্রহিষ্ণু ও দায়িত্বচেতন এবং এই ভাবেই কাক্সিক্ষত সামগ্র্যের সন্ধানী। প্রেম ও কল্পনামেদুর উপন্যাস পাঠের সঙ্গে সঙ্গে যিনি অল্পবয়স থেকে ইতিহাসেরও মগ্ন পাঠক, তাঁর কাছে এমনটিই প্রত্যাশিত। ‘আগুনের পরশমণি’ শীর্ষক প্রবন্ধে রবীন্দ্রগানে-অভিভূত বৃহত্তর পাঠকসমাজের কাছে তুলে ধরেছেন এখনও-অচেনা এক রবীন্দ্রনাথকে, যিনি শুধু আসমানদারি করে সময় কাটাননি, মাটির কাছাকাছি কর্তব্যনিষ্ঠ জমিনদারি করেও নজির স্থাপন করেছেন। শামসুর রাহমানকে নিয়ে লিখিত একাধিক প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকারেও একজন দায়িত্বশীল কবির পরিচয় খুঁজে পাই। সোনালি কাবিন পড়ার পর থেকে যে-বইটিকে আর কোনোভাবে হাতছাড়া করেননি, কপটতা ও অকপটতার প্রশ্নে সেই বইয়ের লেখকের স্ববিরোধী চেতনাকে চিহ্নিত করেছেন নির্মোহভাবে। একসময়ের সাড়াজাগানো পত্রিকা এপিটাফ-এর সম্পাদক ও আপাদমস্তক কবি মিনার মনসুর এই বইয়ে যে-পক্ষপাতহীন বিশ্লেষণী শক্তির পরিচয় দিয়েছেন তা প্রশংসাযোগ্য। লক্ষ করছি, একজন দূরবর্তী স্বভাবের কবিকে চিহ্নায়নেও তিনি নির্দ্বিধ ও স্বতঃস্ফূর্ত। বর্তমানের সমাজ-রাজনীতির প্রতি আপাত/প্রায়-উদাসীন সিকদার আমিনুল হক, কখনো-কখনো ঈষৎ বিচলিত তবু বাংলার মাটি ও ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির প্রতি দায়িত্ববান সৈয়দ শামসুল হক এবং বিষণ্ন দেবদূত আর সশস্ত্র সুন্দরের বৈপরীত্ব-ধারণকারী কবি রফিক আজাদের কাব্যচেতনাও তাঁর চোখে ধরা পড়েছে স্পষ্টভাবে। সবমিলিয়ে কালান্তরে কবির মুখ ও মুখোশ বইটি একজন কবির লিখিত অন্য কবিদের বিশ্বস্ত মূল্যায়নের দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে বলে আমাদের ধারণা।
মিনার মনসুরের লেখালেখির শুরু সত্তরের দ্বিতীয়ার্ধে। মূলত কবি। জন্ম ২০ জুলাই ১৯৬০ সালে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার বরলিয়া গ্রামে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে কৃতিত্বের সঙ্গে বিএ (সম্মান) এবং এমএ পাস করেছেন যথাক্রমে ১৯৮৩ ও ১৯৮৪ সালে। বর্তমানে দৈনিক ইত্তেফাকের সহকারী সম্পাদক হিসেবে কর্মরত। প্রকাশিত গ্রন্থ কবিতা: ‘এই অবরুদ্ধ মানচিত্রে’ (১৯৮৩); ‘অনন্তের দিনরাত্রি’ (১৯৮৬); ‘অবিনশ্বর মানুষ’ (১৯৮৯); ‘আমার আকাশ’ (১৯৯১); ‘জলের অতিথি’ (১৯৯৪); ‘কবিতাসংগ্রহ’ (২০০১) এবং ‘মা এখন থেমে যাওয়া নদী’ (২০১২); ‘মিনার মনসুরের দ্রোহের কবিতা’ (২০১৩)। ছড়া: ‘হেলাফেলার ছড়া’ (১৯৮৯)। গবেষণা: ‘হাসান হাফিজুর রহমান: বিমুখ প্রান্তরে নিঃসঙ্গ বাতিঘর’, (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৯) এবং ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত: জীবন ও কর্ম’, (বাংলা একাডেমী, ২০১২)। প্রবন্ধ: ‘শোষণমুক্তির লড়াইয়ে মধ্যবিত্তের ভূমিকা’, (১৯৮৭) এবং ‘কবি ও কবিতার সংগ্রাম’ (২০১৩)। জীবনী: ‘ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত’, (বাংলা একাডেমী, ১৯৯৭)। সম্পাদিত গ্রন্থ ‘শেখ মুজিব একটি লাল গোলাপ’ (প্রথম প্রকাশ: ১৯৭৯)। ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মারকগ্রন্থ’ (১৯৯৪); ‘শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের আত্মকথা’ (১৯৯৫); ‘মুক্তিযুদ্ধের উপেক্ষিত বীর যোদ্ধারা’ (২০০৮) এবং ‘বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও উন্নয়ন: বিশিষ্টজনের ভাবনা’ (২০১০)।