রাজিনের উড়ন্ত সাইকেল। অসাধারণ এক শিশুতোষ গল্পের বই। লিখেছেন শিশুসাহিত্যের জীবন্ত কিংবদন্তী আমীরুল ইসলাম। শিশুদের মন ও মননের বিকাশ সাধনের সহায়ক একটি চমৎকার গল্পের বই। রাজিন নামের এক অসাধারণ মেধাবী শিশুর সারল্য, নিষ্পাপ প্রশ্ন, সার্বক্ষণিক কৌতূহল ও আবেগ -অনুভূতি নিয়ে লেখা বইটি যে কোন শিশুর জ্ঞানচক্ষু খুলে দেবার এক চমৎকার আয়োজন। বইটির প্রতিটি গল্পের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে রয়েছে শিশুদের জীবন ও বেড়ে ওঠার অগনিত শিক্ষা। খ্যাতিমান প্রচ্ছদশিল্পী ধ্রুব এষ'র অসাধারণ প্রচ্ছদে বইটি প্রকাশ করেছে প্রতিভা প্রকাশ। বইটির প্রথম গল্পে চাঁদের চেয়ে পিজাকেই বেশী গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। একটি শিশুর সব খেয়াল যখন একটি নির্দিষ্ট দিকে থাকে, তখন তার কাছে অন্য সবকিছু গৌণ মনে হয়। তাই রাজিনের কাছে সুন্দর চাঁদটিকে একটি সুন্দর চিকেন পিজার মতো মনে হয়। দ্বিতীয় গল্পে ক্লাস টুতে পড়া রাজিন নানান প্রশ্ন করে তার মনের মতো উত্তর না পেয়ে চমৎকার একটি বাক্য ছুড়ে দেয় - " না জানলে অনেক সুবিধা আছে, কোন উত্তর দিতে হয় না"। আবার লেখক যখন নিজেকে বোকা বলেছেন, রাজিন আরেকটা প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে- "সবাই তাহলে তোমাকে ট্যালেন্ট বলে কেন?" লেখকের উত্তর - "ওরা আমার চেয়ে বোকা"। এখানে প্রতিটি বাক্যে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা লুকিয়ে রয়েছে। তৃতীয় গল্পে পশু-পাখির প্রতি রাজিনের অকৃত্রিম ভালোবাসা সত্যিই শিক্ষণীয়। একদিন সে ক্ষুধার্ত কুকুরকে নিজের বার্গারও খেতে দেয়। তার খুব শখ মাছ, বেড়াল, কুকুর ও পাখি পোষা। শিশুদের মনে স্বপ্নের যে স্বাতন্ত্র্য ও বৈপরীত্য আছে তাও তুলে ধরা হয়েছে গল্পটিতে। সে ডাইনোসোরও পুষতে চায়। তার ধারণায় নেই যে ডাইনোসর একটি বিলুপ্ত প্রাণী। কিন্তু তার প্রতি অসম্ভব আগ্রহ রয়েছে। রাজিনের সাইকেল খুব প্রিয়। তাই সে পুরস্কার হিসাবেও সাইকেল চায়। কখনো কখনো শিশুদের মধ্যে কিছু সরল বিশ্বাস থাকে। আমরা যা শেখায় তাইই তারা দ্রুত শিখে নেয়। যেমন কেউ চিকেন খেলে চিকেন,গরু খেলে গরু, হাতি খেলে হাতি বা পিঁপড়ে খেলে পিঁপড়ে হয়ে যাবে। আর সেই ভাবনা থেকেই ডাইনোসরের ডিম খেতে চায় রাজিন। আবার শিশুরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নিজেকে সেরা ভাবতে পছন্দ করে। তাই একটি গল্পে রাজিন বলে "আমি শুধু জমিদার নই ডাবল জমিদার"। বইটিতে অনেকগুলো শিক্ষার মধ্যে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হল "শিশুদের না বলতে নেই" আর "শিশুদের অধিকার সবার আগে"। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল শিশুরা তার পক্ষের মানুষকে অসম্ভব ভালোবাসে। তাই রাজিনও তার কাকুকে বলে "বিশ্বাস করো কাকু তোমাকে শ্রদ্ধা করি ভালবাসি, ভয় পাইনা। কেননা তুমি বলেছো শিশুদের অধিকার আগে"। শিশুরা সাধারণত কৌতুকপ্রিয় হয়। তেমনি রাজিনও মজা করতে পচ্ছন্দ করে। তাই সে বলে নিজের ভুঁড়িটা ফুটবল খেলতে দেবে! ফেটে গেলে সমান হয়ে যাবে। আর কেউ তার পেটকে ফুটবল বলবে না। ইচ্ছে মতো খেতে পারবে সে। অন্য একটি গল্পে রাজিন অনেক কৌতূহলী বলে কাকু তার নাম দিতে চায় সক্রেটিস। যেখানে উল্লেখ আছে "যে ছেলেগুলো নতুন কিছু করতে চায়, সে অনেক বড় হয়।" একবার এক প্রশ্নের জবাবে দুই রবীনের অনেকগুলো পার্থক্য বলে রাজিন। আর কি কি পার্থক্য আছে প্রশ্ন করলে রাজিন বলে "কোন পার্থক্য নেই। দুইজনই মানুষ। মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য নেই। মানুষ আর পশুতে পার্থক্য আছে।" কি অসাধারণ শিক্ষা লুকিয়ে আছে বাক্যগুলোর মধ্যে! একটি গল্পে রাজিন রাগে টিফিনের টাকা ছুড়ে দেয়। তারপর ময়লা কলম তুলে নাড়াচাড়া করে। সেটা হাত থেকে নিয়ে ফেলে দিতেই বলে ওঠে "তুমিi তো বললে কোন কিছু ওভাবে ছুড়ে ফেলতে নেই"। অন্য গল্পে সে বলে "মানুষ চুরি করবে কেন? অন্য কাজ করবে"। আরেকটি গল্পে বলে "একটু আগেই বললা আমি ফকির নাকি? আবার এখন বলছো আমি এত জিনিস কিনবো কি করে? এক মুখে কয় রকম কথা বলো?" সরল প্রশ্ন রাজিনের। সাগর ভাইকে সে প্রশ্নঃ কোন জিনিস জন্ম থেকেই বুড়া? আবার নিজেই উত্তর বলে দেয় - বুড়া আঙ্গুল। পরের গল্পে একই রকম প্রশ্ন "একটু আগেই বললা তুমি আমার প্রাণ, কলিজার টুকরা অথচ মোবাইল গেম খেলতে দাওনা। আবার মোবাইলটা হাতে পেতেই ঠোঁটে ফুটে ওঠে সরল হাসি। শিশুদের বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের বায়না থাকে। তেমনি রাজিনেরও ট্যাব, কারাম বোর্ডসহ নানান বায়না থাকে। সেগুলো পেয়ে খুশিতে নেচে উঠে সে। ইউটিউব দেখে নানান কৌশল শেখে রাজিন। এটি আধুনিক প্রতিযোগিতামূলক সভ্যতার সাথে তাল মেলাতে শিশুদেরকে বিজ্ঞান মনস্ক হবার তাগিদ দেয়। রাজিন তার কাকাকে খুব ভালবাসে। তাই সে বলে "কাকা রাজিনের কথা ভেবোনা। নিজের কথাও ভাব। সে কাকাতে রাত না জেগে শুয়ে পড়তে বলে, আদর করে, শাসন করে। আবার সে জন্মদিনে সারপ্রাইজ দিতে চায়। কিছুই দিতে পারছেনা জানিয়ে একসময় এসি রুমে টেনে নিয়ে যায়। টেবিলে ব্লাক ফরেস্ট কেক, জ্বলন্ত মোমবাতি, রঙিন টুপি, পাটি বেলুন, ইত্যাদি সারপ্রাইজ দেয়। রাজিন গাছ ভালোবাসে। তাই লেবু পাতা ছেড়ে না। কেননা সে বেঁচে থাকলেই গন্ধ ছড়াবে। সে গাছ ভালবাসে, কিন্তু গাছ হতে ইচ্ছে করেনা। কেননা গাছ সুন্দর হলেও চলাফেরা করতে পারেনা। পাখি হতে চায়। পাখি হলে মুক্ত আকাশে স্বাধীনভাবে ওড়া যায়। সে প্রকৃতি ভালোবাসে। তাই করোনা বিদায় নিলে সে প্রকৃতির কাছে যেতে চায়, সমুদ্রের কাছে যেতে চায়, পাহাড়ের কাছে যেতে চায়। শিশুরা নানা রঙের বর্ণিল খেলায় মেতে উঠতে পছন্দ করে। তাই বইটি নানান রঙের অক্ষরে সাজানো হয়েছে। আরেকটি চমৎকার বিষয় লক্ষ্যণীয় যে শিশুরা অনেকসময় ঘুরে ঘুরে বই পড়তে পছন্দ করে। তাই এই বইটি নির্মাণের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি মাথায় রেখেই কখনো কখনো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ছাপানো হয়েছে।
জন্ম ৭ই এপ্রিল ১৯৬৪, লালবাগ, ঢাকা । পিতা প্ৰয়াত সাইফুর রহমান। মাতা প্ৰয়াত আনজিরা খাতুন। পিতৃব্য প্রয়াত কবি হাবীবুর রহমান, খ্যাতনামা শিশুসাহিত্যিক । শিশুসাহিত্যের সকল শাখায় সমান স্বচ্ছন্দ। ২০০৬ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। সবচেয়ে কম বয়সে খামখেয়ালি ছড়াগ্রন্থের জন্য পেয়েছেন শিশু একাডেমী আয়োজিত অগ্রণী ব্যাংক শিশুসাহিত্য পুরস্কার। পরে এই পুরস্কার পেয়েছেন আরও পাঁচবার । এ ছাড়াও পেয়েছেন সিকানন্দার আবু জাফর সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৪), নুরুল কাদের শিশুসাহিত্য পুরস্কার (২০০৩), পদক্ষেপ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৫), ছােটদের পত্রিকা পুরস্কার (২০০৭), ছোটদের মেলা পুরস্কার (২০০৯/২০১০), জাতীয় ছড়া উৎসব। ২০১১ সম্মাননা, শামসুর রাহমান সাহিত্য পুরস্কার (২০১১) এবং ওয়েস্ট এন্ড হাইস্কুল পুনর্মিলনী সম্মাননা। ২০১১ । কলকাতা থেকে অন্নদাশঙ্কর সাহিত্য পুরস্কার ২০১২। প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা দুই শতাধিক। সবই শিশুসাহিত্য। দেশের খ্যাতিমান সকল প্রকাশনা সংস্থা থেকে এক বা একাধিক বই প্ৰকাশিত হয়েছে । দশ বছর সম্পাদক ছিলেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে প্রকাশিত কিশোর-তরুণদের উৎকর্ষধ্যমী মাসিক আসন্না-র । অধুনালুপ্ত দৈনিক বাংলার কিশোরদের পাতা সম্পাদনা করেছেন। পাঁচ বছর । বর্তমানে চ্যানেল আই-এর জেনারেল ম্যানেজারের দায়িত্বে কর্মরত। সাপ্তাহিক-এর প্রকাশকও তিনি। এ ছাড়া বাংলা একাডেমির ফেলো, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের স্থাপনা-সদস্য। প্রিয় শখ পুরোনো বই ও চিত্ৰকলা সংগ্ৰহ, বইপড়া, দাবাখেলা, রবীন্দ্রসংগীত শোনা ।