বাঙলাদেশে অপরাধের জগৎ বদরুদ্দীন উমরের সম্প্রতি প্রকাশিত গ্রন্থ বাঙলাদেশে অপরাধের জগৎ। এ গ্রন্থের লেখক কথা বলেছেন সমাজের সচেতন দর্শক এবং সমাজ বিশ্লেষক হিসেবে। আর তাই তাঁর লেখাও হয়ে উঠেছে সমাজেরই দর্পণ। উমরের সরল অথচ গভীর, ধীর অথচ তীব্র, বর্তমান অথচ ভবিষ্যতের বার্তাবাহী লেখাগুলো আমাদের রাজনৈতিক সাহিত্যের জীবন্ত সম্পদতুল্য। উমর গ্রন্থটির ভূমিকায় লিখেছেন — ‘‘দেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে, সর্বস্তরে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত লোকজন ও তাদের সাথে সম্পর্কিত লোকেরা চুরি, ঘুষখোরী, দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে যেভাবে ধ্বংসাত্মক কাÐ করছে তার একটা বিবরণ এ বই-এ অন্তর্ভুক্ত লেখাগুলির মধ্যে আছে। এর থেকে বোঝা যাবে বর্তমান শাসক শ্রেণী ও তাদের প্রধান রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ কী ভাবে এক বড় অভিশাপের মতো এ দেশের জনগণের জীবন বিপন্ন ও বিপর্যস্ত করছে।’’ তাই, বস্তুত চলমান ইতিহাসের কড়চা হিসেবে শুধু নয়, শেষ পর্যন্ত আগামী দিনের আন্দোলন-সংগ্রাম-বিপ্লবের রসদ হিসেবেও এ গ্রন্থের লেখাগুলো কাজ করছে। লেখক পরিচিতি ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান শহরে বদরুদ্দীন উমর জন্মলাভ করেন। তার পিতা আবুল হাশিম এবং মাতা মেহেরবানু বেগম। ঊনিশ শতকের শেষ দশক থেকে রাজনীতির সাথে সম্পর্কিত এই পরিবারে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কমিউনিস্ট, অকমিউনিস্ট, কৃষক সংগঠনের যুক্ত নেতা ও কর্মী ছিলেন। পরিবেশ ছিল মুক্ত। জীবন ছিল স্বচ্ছল। একটি সুবিধাভোগী শ্রেণীতে জন্মেও তারা ছিলেন মানবদরদী, দেশহিতৈষী, স্বদেশপ্রেমী, জ্ঞান-বিজ্ঞানে আগ্রহী Ñ জীবনকে পরীক্ষা-নিরীক্ষার ভেতর দিয়ে নিয়ে দেশকে ভালাবাসার প্রচেষ্টা তাঁদের অনেকেরই ছিল। ১৯৫১ সালে তাঁরা বর্ধমান থেকে ঢাকায় আসেন। ১৯৫২ এর ফেব্রæয়ারি মাসে ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এর অনুরোধক্রমে আমাদের ভাষার লড়াই নামক পুস্তিকা প্রণয়ন করেন উমর, যা পরিষদ কর্তৃক দশ হাজার কপি মুদ্রণ, বিতরণ এবং মাইকে পাঠ করা হয়। এভাবে ঢাকায় উমরের রাজনৈতিক সাহিত্য রচনা জীবনের গুরুত্বপূর্ণ প্রারম্ভকাল সূচিত হয়। পরে দেখা যায়, তিনি আমাদের দেশের রাজনৈতিক সাহিত্য রচনার ক্ষেত্রে প্রধান পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। ১৯৫৪-এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষকতা দিয়ে তাঁর কর্মজীবন শুরু হয়। ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম কলেজে এবং পরে ১৯৫৭ সালে রাজাশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয়ের কুইন্স কলেজ থেকে পিপিই (দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতিতে) ডিগ্রী লাভ করেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খানের ক্রমাগত চাপে এবং সার্বক্ষণিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ত্যাগ করে ঢাকায় আসেন এবং ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) হক-তোয়াহা গ্রæপে যোগদান করে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন, যে জীবন আজ পর্যন্ত অব্যাহত আছে। ১৯৬৯ সালের মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর বহুল আলোচিত ট্রিলজি সাম্প্রদায়িকতা, সংস্কৃতির সংকট এবং সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা। আর এরপর একে একে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর শতাধিক বাংলা ও ইংরেজি গ্রন্থ যা তিনি প্রকাশ করেছেন ৬০, ৭০, ৮০, ৯০, ০, ১০ এবং ২০ এর দশকে যথাক্রমে ৪, ১৩, ২২, ২৭, ৩৪, ১৯ এবং ১০টি (আনুমানিক প্রকাশিতব্য) − যা বিস্ময়কর! উল্লেখ্য, তার প্রণীত একটি গ্রন্থও নেই যা মূল্যবান নয় এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষার অযোগ্য। ষাটের দশকের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সময় ফেব্রæয়ারি ১৯৭০ থেকে মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত তিনি গণশক্তি পত্রিকার ৫৫টি সংখ্যা সম্পাদনা করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা তৎকালীন কমিউনিস্ট আন্দোলনের দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম দলিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে পার্টির নির্দেশে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে প্রত্যন্ত গ্রাম অঞ্চলে পার্টি কমরেডদের সাথে কাজের প্রচেষ্টা চালান। তিনি মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না দিয়ে চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং অল্প সময়ের ব্যবধানে সেখান থেকে পদত্যাগও করেন। ইপিসিপি (এমএল) থেকে পদত্যাগের পর নতুনভাবে রাজনীতি সংগঠিত করার কাজে নিয়োজিত হন। এখানেও ভাঙাগড়ার মধ্যদিয়ে অগ্রসর হতে থাকেন। ১৯৮০ এর দশক থেকে পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী জোট, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক কমিটি এবং ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মুক্তি সংগ্রাম পরিষদ গঠনে ভূমিকা পালন করেন। বাঙলাদেশ লেখক শিবির, বাংলাদেশ কৃষক ফেডারেশন, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল এবং ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী গণতান্ত্রিক কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি দেশে ও বিদেশে বহু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সেমিনার সিম্পোজিয়ামে যোগদান করেন।
বদরুদ্দীন উমরের জন্ম ১৯৩১ সালের ২০ ডিসেম্বর পশ্চিম বাঙলার বর্ধমান শহরে। মার্কসবাদী তাত্ত্বিক, রাজনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক ও ইতিহাসবিদ হিসেবে তিনি বাঙলাদেশে সুপরিচিত। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এম. এ. পাশ করার আগেই ১৯৫৪ সালে দর্শন বিভাগে অস্থায়ীভাবে শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৫৫ সালে এম. এ. পাশ করার পর ১৯৫৬ সালে চট্টগ্রাম সরকারী কলেজে এবং ১৯৫৭ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৬১ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় হতে দর্শন, রাজনীতি ও অর্থনীতি এই তিন বিষয়ে অনার্স ডিগ্ৰী অর্জন করেন। ১৯৬৩ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগেরও তিনি ছিলেন প্রতিষ্ঠাতা। ষাটের দশকে প্রকাশিত তাঁর তিনটি বই সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৬), সংস্কৃতির সংকট (১৯৬৭) ও সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা (১৯৬৯) তত্ত্বকালে বাঙালী জাতীয়তাবাদের বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সময় পাকিস্তান সরকারের সাথে তাঁর বিরোধ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এবং তিনি নিজেই ১৯৬৮ সালে অধ্যাপনার কাজে ইস্তফা দিয়ে সরাসরি রাজনীতি ও সার্বক্ষণিক লেখালেখিতে নিজেকে নিয়োজিত করেন।