এযাবৎকালে বিশ্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি ও বাজারে দুষ্প্রাপ্যতা কিংবা খাদ্য মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেলে, প্রধানত এই তিনটি কারণে দুর্ভিক্ষ সংগঠিত হয়েছে আর এর ফলে অসংখ্য মানুষ মৃত্যুবরণ করেছে, রোগাক্লিষ্ট হয়েছে আর পুষ্টিহীনতায় ভুগেছে। জনসংখ্যার দিক থেকে পৃথিবীর অষ্টম বৃহত্তম দেশ বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। এখানকার মানুষের জীবনযাত্রায় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি আর তা কিনতে না পেরে ক্ষুধায় হাহাকারে জর্জরিত হওয়া প্রায় নিত্য নৈমিত্তিক ঘটনা। এরকম অবস্থায় কালোবাজারী ও মজুদদারী হলো দরিদ্র জনগণকে সামন্ত-ধনিক শ্রেণীর শোষণ-নিপীড়নের হাতিয়ার। নীতিগত দুর্বলতা যেমন গ্রামাঞ্চলকে উপেক্ষা করে শহরাঞ্চলে রেশনিং কার্যক্রমকে প্রাধান্য দেওয়া ও সরকারী আমলাতন্ত্রের দুর্নীতি ও অদক্ষতাও দুর্ভিক্ষের অপর একটি কারণ। বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশের মানুষ দুটি খুব বড় আকারের দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়। একটি হলো বৃটিশ আমলে অবিভক্ত বাংলার ১৯৪৩ সালে আর অপরটি হলো স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ। অমর্ত্য সেন, মধুশ্রী মুখোপাধ্যায়, জনম মুখার্জি, বৃটিশ সরকার কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন, আলমগীর মহিউদ্দিন, নাওমি হোসেন, প্রমুখসহ দেশী-বিদেশী অসংখ্য লেখক ও অর্থনীতিবিদ এই দুইটি দুর্ভিক্ষের উপর তাদের পুস্তক ও গবেষণা কর্মে আলোকপাত করেছেন। তেতাল্লিশ ও চুয়াত্তরের মন্বন্তর পুস্তকে এই দুটি দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে বিভিন্ন পুস্তকে দেওয়া তথ্য ও মতামত পর্যালোচনা করে দুর্ভিক্ষ দুটির কারণ ও দায়দায়িত্ব নির্ধারণের চেষ্টা করা হয়েছে। এতে দেখা যায় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধির তুলনায় মানুষের ক্রয় ক্ষমতা কমে যাওয়া দুটি দুর্ভিক্ষেরই প্রধানতম কারণ। গ্রামাঞ্চলকে উপেক্ষা করে শহরমুখী খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থাও ছিল একটি অন্যতম ত্রæটি। সাম্রাজ্যবাদী বৃটিশদের বাংলা থেকে সম্পদ লুণ্ঠন এবং পাকিস্তানীদের বাংলাদেশ থেকে ঔপনিবেশিক লুণ্ঠন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে ঝাঁঝরা করে দিয়েছিল। কালোবাজারী, মজুদদারী, রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন, আমলাতান্ত্রিক দুর্নীতি ও ব্যর্থতা, ত্রাণ বিতরণে সারা বাংলায় বিশেষ করে কলকাতায় আশ্রিতদের মাঝে সাম্প্রদায়িক (হিন্দু- মুসলিম) পক্ষপাতিত্ব, বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালের প্রলয়ংকারী বন্যা ও চোরাচালানি পরিস্থিতিকে আরও নাজুক করে তোলে। ১৯৪৩ ও ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ দুটিতেই লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণহানী ঘটে। তা এড়াতে সরকারকে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কালোবাজারী- মজুদদারী ঠেকানো এবং সময়মতো গ্রামাঞ্চলে পর্যাপ্ত খাদ্য বিতরণ ব্যবস্থা তথা ত্রাণ সহায়তা দিলে এই বিপর্যয়গুলো অনেকটা হলেও এড়ানো যেত। নাসির আরিফ মাহমুদ (জন্ম: ১৯৫৮) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতকসহ স্নাতকোত্তর এবং ব্যবসা প্রশাসন ইনস্টিটিউট (আইবিএ) থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন। প্রথম দিকে স্বল্পকালীন সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে চাকরি করলেও তার জীবনের বেশীরভাগ সময় কেটেছে সরকারি ক্যাডার কর্মকর্তা হিসেবে। খাদ্য, নৌ-পরিবহন ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে তার দীর্ঘদিনের কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। কর্ম জীবনে দেশে-বিদেশে তিনি অনেক প্রশিক্ষণ-কর্মশালা- সেমিনারে অংশ গ্রহণ করেছেন। সমুদ্রে জলদস্যুতা প্রতিরোধে সিঙ্গাপুর ভিত্তিক আঞ্চলিক সংগঠন রিক্যাপ (জবঈঅঅচ) এর ভাইস চেয়ারম্যান এর দায়িত্বও পালন করেছেন। তার কৈশোর ও প্রথম যৌবন কেটেছে মুক্তিযুদ্ধ ও সামাজিক-রাজনৈতিক অস্থির সময়ে। তার চাকরিকালীন সময়ে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি ও তার মোকাবিলার কাজটি তিনি কাছ থেকে দেখেছেন। ক্ষুধা, দারিদ্র, ও উন্নয়ন অর্থনীতি বিষয়ে তার বিশেষ ঝোঁক রয়েছে। তার পড়াশোনা ও অভিজ্ঞতার আলোকে ক্ষুধা ও দারিদ্র নিয়ে এই বইটি লেখার প্রচেষ্টা নিয়েছেন। তেতাল্লিশ ও চুয়াত্তরের মন্বন্তর তার প্রথম এবং একমাত্র গ্রন্থ।