বহুদিন থেকে মনোবাসনা ছিল যে হিন্দুদের- বিশেষত পণ্ডিত সমুদয়কে ‘ইসলাম’ ধর্মের সঙ্গে পরিচিত করানোর জন্য একখানা গ্রন্থ রচনা করব। সংযোগবশত তার সুযোগ পেলাম ১৯২২ সালের কারাবাসের কালে। সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত সমাজ সাধারণত হিন্দি ভাষার প্রতি রুচি কমই রাখেন, দ্বিতীয়ত তাঁদের পরিচিত ভাষায় লিখলে গ্রন্থটি ভালো প্রচার পাবে এই সব ভেবে আমি প্রথমে সংস্কৃত ভাষাতেই লেখা আরম্ভ করি। কিছুটা লেখার পর সেটা আমি আমার সহযোগী নারায়ণবাবুকে পড়ে শোনাই। তিনি রায় দিলেন যে এ ধরনের গ্রন্থ হিন্দি ভাষাতেই লেখা উচিত। তারপর থেকে ‘ইসলাম ধর্মের রূপরেখা’র কিছু অংশ হিন্দিতেও লেখা হয়। কারাবাস থেকে মুক্ত হওয়ার পর অনেক মহানুভব সুহৃদ এটিকে ছাপাবার পরামর্শ দেন, কিন্তু আমি নিরুপায় ছিলাম, কারণ তখনো গ্রন্থটি পরিষ্কার করে লেখা হয়ে ওঠেনি। তাছাড়া বাইরে অন্যান্য কাজের ধাক্কায় লেখাটির সংস্কারও করতে পারছিলাম না। সৌভাগ্যবশত সময় পাওয়া মাত্রই গ্রন্থটিকে সমাপ্ত করার জন্য বিশেষভাবে সচেষ্ট হই। জানি না সংস্কৃত ভাষায় ‘ইসলাম ধর্মের রূপরেখা’ কবে পর্যন্ত পাঠকের হাতে গিয়ে পৌঁছাবে। তবে হিন্দি ভাষায় ‘ইসলাম ধর্মের রূপরেখা’ অবশেষে পাঠকের হাতে পৌঁছাচ্ছে। হিন্দু ধর্মে যেমন অনেক সম্প্রদায়ের অবস্থান আছে এবং তাদের সিদ্ধান্তগুলির মধ্যেও যথেষ্ট প্রভেদ আছে, ইসলামেরও তেমনই অবস্থা। অতএব সেই বিড়ম্বনা এড়াবার জন্য আমি মূল ‘কোরান’-এর শব্দকে কেবল ভাষ্য পরিবর্তন করে তার সাহায্যে ইসলাম ধর্মকে ধরার চেষ্টা করেছি। খুব কম জায়গাতেই নিজের মতামত ব্যক্ত করেছি। যেটুকু করেছি সেটুকুও বিষয়টিকে পাঠকের সামনে স্পষ্ট করার উদ্দেশ্যে করেছি। গ্রন্থটি রচনার প্রধান উদ্দেশ্য হিন্দুদের আপন প্রতিবেশী মুসলমান ভাইদের ধর্ম সম্বন্ধে একটা ধারণা দেওয়া। যার অভাবে দুটি সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর সম্বন্ধে অনেক ভ্রান্তি উৎপন্ন হয়ে চলেছে।
তাঁর জন্ম ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে সনাতন হিন্দু ভূমিহার ব্রাহ্মণ পরিবারে। জন্মস্থান উত্তর প্রদেশের আজমগড়ের একটি ছোট্ট গ্রাম। তাঁর আসল নাম ছিল কেদারনাথ পাণ্ডে। ছোটোবেলাতেই তিনি মাকে হারান। তাঁর পিতা গোবর্ধন পান্ডে ছিলেন একজন কৃষক। বাল্য কালে তিনি একটি গ্রাম্য পাঠশালায় ভর্তি হয়েছিলেন। আর এটিই ছিলো তাঁর জীবনে একমাত্র প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। অষ্টম শ্রেণী অবধি অধ্যয়ন করেছিলেন। এখানে তিনি উর্দু ও সংস্কৃতের উপর প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন। তিনি বহু ভাষায় শিক্ষা করেছিলেন যথা : হিন্দি, উর্দু, বাংলা, পালি, সংস্কৃত, আরবি, ফারসি, ইংরেজি, তিব্বতি ও রুশ।
পুরস্কার তালিকা পদ্মভূষণ (১৯৬৩) সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার (১৯৫৮)
ব্যক্তিগত জীবন জালিওয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড (১৯১৯) তাঁকে একজন শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী কর্মীতে রূপান্তরিত করে। এ সময় ইংরেজ বিরোধী কার্যকলাপের অভিযোগে তাকে আটক করা হয় এবং তিন বছরের কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়। এ সময়টিতে তিনি পবিত্র কুরআন শরীফ সংস্কৃতে অনুবাদ করেন। পালি ও সিংহল ভাষা শিখে তিনি মূল বৌদ্ধ গ্রন্থগুলো পড়া শুরু করেন। এ সময় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম দ্বারা আকৃষ্ট হন এবং নিজ নাম পরিবর্তন করে রাখেন রাহুল (বুদ্ধের পুত্রের নামানুসারে) সাংকৃত্যায়ন (আত্তীকরণ করে যে)।, জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি বিহারে চলে যান এবং ডঃ রাজেন্দ্র প্রসাদ-এর সাথে কাজ করা শুরু করেন। তিনি গান্ধিজীর আদর্শে অনুপ্রাণিত ছিলেন এবং এসময় তিনি গান্ধীজী প্রণীত কর্মসূচীতে যোগদান করেন। যদিও তাঁর কোনো আনুষ্ঠানিক শিক্ষা ছিলো না, তবুও তার অসাধারণ পান্ডিত্যের জন্য রাশিয়ায় থাকাকালীন লেনিনগ্রাদ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে শিক্ষকতার অনুরোধ করা হয়। তিনি তা গ্রহণ করেছিলেন। ভারতে এসে তিনি ডঃ কমলা নামক একজন ভারতীয় নেপালি মহিলা কে বিয়ে করেন। তাদের দুই সন্তান হয়, কন্যা জয়া ও পুত্র জিৎ। পরে শ্রীলংকায় (তৎকালীন সিংহল) বিদ্যালঙ্কার বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে দার্জিলিংয়ে, ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের ১৪ এপ্রিল তারিখে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।